Labels: , ,

বনী কুরায়জা গোত্রের সকল ইহুদি হত্যা করা প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা

উইকিপিডিয়া থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন ও কর্মের অধ্যায়ে সমালোচনা নামক একটি চাপ্টার থাকে। সেখানে এক কথায় বলে দেওয়া হয় বনী কুরায়জা গোত্রের সকল ইহুদী হত্যা করার মাধ্যমে নাকি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিংস্র রুপ বিশ্ব বাসীর কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। নাউযুবিল্লাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত টা ছিল বনী কুরায়জা গোত্রের সকল ইহুদী কে হত্যা করা এবং বনী কুরায়জা গোত্রের নারীদেরকে দাসী হিসাবে বিক্রি করে দেয়া। ইসলামের ইতিহাসেও এটি সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ ঘটনা যে যুদ্ধবন্দী সকল পুরুষ কে একসাথে হত্যা করা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত যত যুদ্ধবন্দী ছিল সবার কাছ থেকে হয় মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছিল নতুবা পুরা গোত্রটিকে নির্বাসন করে দেয়া হয়েছিল। কখনই কোন যুদ্ধ বন্দীকে হত্যা করা হয় নি বা কোন যুদ্ধবন্দীকে দাস বানান হয় নি। যেমন বদর যুদ্ধে যে সকল কাফের মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিল তাদের কাছ থেকে মুক্তিপন আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের কে দাসও বানান হয় নি বা তাদের কে হত্যা করাও হয় নি।

মক্কা বিজয়ের পর হুনাইনের যুদ্ধের পরও কোন কাফের কে সাহাবীরা দাস বানান নি বা হত্যা করেন নি। তাইলে কোন প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী কুরায়জা গোত্রের ইহুদীদের ব্যাপারে এত কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেটা উনি কখন অন্য কোন ইহুদী গোত্রের ব্যাপারে নেন নি তা আমি এখানে আলোচনা করব।

প্রাচীন কাল থেকেই দূতদের কে সম্মান করা হত। এক দেশের সাথে আরেক দেশের যত ঝামেলাই থাকুক না কেন রাজদূত যদি কখন কোন খবর নিয়ে বিরুদ্ধ শিবিরে যেত তাইলে ঐ রাজদূত কে কিছুই বলা হত না। বরং তাকে আপ্যায়ন করা হত। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ও রাজদূত রা নির্বিঘ্নে বিরুদ্ধ শিবিরের তাবুতে যেতে পারতো। তাদের কোন সমস্যাই হত না। দূত হত্যা করাকে একটা খুবই ঘৃণার কাজ হিসাবে দেখা হত। তাবুক যুদ্ধ টা কিন্তু হয়েছিল এই কারনে যে রোমান দের কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সাহাবীকে দূত হিসাবে প্রেরন করেছিলেন রোমান রা তাকে হত্যা করেছিল। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবিত থাকা অবস্থায় যেই সকল ব্যক্তি নিজেদেরকে ভন্ড নবী বলে দাবি করেছিল তারাও তাদের দূত কে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে পাঠিয়েছিল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কে বলেছিলেন যে দূত কে গ্রেফতার করা যদি আন্তর্জাতিক রীতি বিরুদ্ধ না হত তাইলে আমি তোমাদের কে একজন ভন্ড নবীর সমর্থক হিসাবে গ্রেফতার করতাম। যাই হোক দূত হত্যা করার চেয়েও ঘৃনিত কাজ ছিল যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গ করা। মানে ধরেন আপনার সাথে একজনের শান্তিচুক্তি আছে। আপনি আরেকজনের সাথে যুদ্ধে গেলেন। তখন যার সাথে আপনার শান্তি চুক্তি আছে সে ঐ সময়ে আপনার সাথে অঙ্গীকার কৃত শান্তি চুক্তি টা ভঙ্গ করে আপনার শত্রুর সাথে হাত মিলাল ঠিক যখন আপনার সাথে আপনার শত্রুর যুদ্ধ চলছে। অনেক টা পিছন থেকে আপনার পিঠে ছুড়ি বসানো। এই যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। এটা তাওরাত ও ইঞ্জিলেও লেখা ছিল।

রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন আনসার ও মদীনার সকল ইহুদী গোত্রের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন যে বাইরে থেকে কেঊ মদীনা আক্রমন করলে মদীনার সকল গোত্র সম্মিলিত ভাবে তা প্রতিহত করবে। এই চুক্তির মাঝে বনী কুরায়জা গোত্রও ছিল। বনী কুরায়জা গোত্রের সবাই ছিল ইহুদী। খন্দকের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সাহাবীরা মদীনা শহরের শেষ প্রান্তে পরিখা খনন করে কাফেরদের আগমন কে ঠেকাচ্ছিল। মদীনায় তখন পুরুষ সাহাবী ছিল শুধু হাসসান বিন সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু। ঠিক এমন একটি কঠিন মুহূর্তে বনী কুরায়জা গোত্রের প্রধান সর্দার ইহুদী কাব ইবনে আসাদ মক্কার কাফেরদের মিত্র বনী নাযীরের সর্দার হুয়াই ইবনে আখতাবের প্রোরচনায় মদীনা সনদ ভঙ্গ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ওহীর মাধ্যমে এ খবর পান তখন বনী কুরায়জা গোত্রের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য হযরত সাদ ইবনে মুয়ায রাযিয়ালাহু আনহু, হযরত সাদ ইবনে উবাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বনী কুরায়জা গোত্রের কাছে প্রেরন করলেন এবং বলে দিলেন যদি চুক্তি ভঙ্গের কথা সত্য হয় তাইলে ইশারা ইঙ্গিতে আমাকে কথাটা বলবে যাতে অন্যরা চুক্তি ভঙ্গের কথা জানতে না পারে। আর যদি তারা চুক্তিতে অটল থাকার ইচ্ছা পোষন করে তাইলে খুলাখুলি সব কথা বর্ণনা করতে কোন বাধা নাই। কারন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব ভয় পাচ্ছিলেন যে মদীনা এখন অরক্ষিত। যদি সবাই জানতে পারে যে বনী কোরাইজা গোত্র মদীনা সনদ ভঙ্গ করে ফেলেছে আর এখন পিছন থেকে আক্রমন করবে এবং আমাদের নারী ও শিশুদের কে অপহরন করবে তাইলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যাবে। সাহাবীরা খন্দকের যুদ্ধ পরিত্যাগ করে এখন তাদের ঘরে ফিরে যেতে চাবে।

যাই হোক ঐ ৩ জন সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহু বনী কোরায়জা গোত্রের সর্দার কাব ইবনে আসাদের কাছে গেল এবং তাকে চুক্তির ব্যাপারে স্মরন করিয়ে দিল। কাব তখন বলে চুক্তি কিসের আর মুহাম্মাদ কে ? তার সাথে আমাদের কোন চুক্তি নাই। সাহাবীরা ফিরে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে শুধু বলল “আযল ওয়া কারা ” অর্থ্যাৎ আযল ও কারা নামক গোত্রদ্বয় যেমন সাহাবী হযরত খুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে গাদ্দারী করে উনাকে হত্যা করেছিল ঠিক তেমনি বনী কোরায়জা গোত্রের ইহুদীরাও মদীনা সনদ ভঙ্গ করে ফেলেছে। কিন্তু এই চুক্তি ভঙ্গের খবরটি বেশিক্ষন গোপন থাকল না। মুনাফিকরা তা শুনে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে মদীনা ফিরে যেতে চাইল। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার সকল নারী ও শিশুদের কে একটি দূর্গে নিরাপদে রেখে এসেছিলেন। বনী কোরায়জা গোত্রের এক ইহুদী দূর্গের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফুফু হযরত সাফিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা গোপনে একটি কাঠের টুকরা এনে ঐ ইহুদীর মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে ইহুদীটা ঐখানেই মারা যায়। অবস্থা তখন এত নাযুক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের মিত্র বনী গাতফান গোত্রের ২ সর্দার উয়াইনা ইবনে হাসান ও হারিস ইবনে আউফের সাথে এ শর্তে সন্ধি করতে চাইলেন যে মদীনার বাগান সমূহে উৎপন্ন ১/৩ খেজুর প্রতি বছর তাদেরকে দেয়া হবে তাও যেন এখন তারা কাফেরদের কে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু আনসার সাহাবীরা রাযিয়াল্লাহু আনহু এই শর্তে রাজি হয় নি।

সাহাবীরা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন তরবারীর আঘাত ছাড়া আমাদের আর ইহদীদের দেয়ার কিছু নাই। ঠিক এ সময় গাতফান গোত্রের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নুয়াইম ইবনে মাসউদ রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মুখে হাজির হয়ে বলেন সে ইসলাম গ্রহন করেছে। কিন্তু এ খবর আমার কওমের কেউ জানে না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন তুমি একা মানুষ। তুমি পারলে বনু কোরাইজা ও কাফেরদের ঐক্যের মাঝে ফাটল ধরিয়ে দাও। তখন নুয়াইম ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বনু কোরাইজা গোত্রের কাছে গিয়ে বলল কোরাইশরা মক্কায় থাকে। তোমরা কুরাইশদের সাহায্য করার আগে তাদের গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে জামিন হিসাবে রেখে দাও। আবার উনি কুরাইশদের কাছে গিয়ে বলেন বনু কোরাইজা গোত্র তাদের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত। তারা আপনাদের গোত্রের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কে জামিন হিসাবে রেখে পরে তা মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে তুলে দিবে। পরবর্তীতে আবু সুফিয়ান যখন চুড়ান্ত যুদ্ধের সূচনা করতে চাইল তখন বনু কোরাইজা গোত্র আবু সুফিয়ানের কাছে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জামিন হিসাবে চাইল। তখন কুরাইশরা বুঝল নুয়াইম ইবনে মাসউদ এর সব কথা সত্য। আর ঠিক সেই রাতেই কাফেরদের উপর এক বিরাট ঝঞ্জা বায়ু প্রেরন হয়। ফলে কুরাইশ ও বনু গাতফান গোত্রের তাবুগুলি উপড়ে যায় তাদের অর্ধেক ঘোড়া গুলি মারা যায়। ফলে কুরাইশরা যুদ্ধ করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে মক্কা অভিমুখে রওনা হয়। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয়ের বেশে মদীনায় ফিরে যান। কিন্তু মদিনায় ফিরে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্ত্র শস্ত্র খুলে ফেলতে চাইলে জিবরাইল আলাইহিস সাল্লম এসে বলেন যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নি। আপনি বনু কোরাইজা গোত্রের অভিমুখে চলেন। তারপর একটানা ২৫ দিন পর্যন্ত বনু কোরাইজা গোত্রকে অবরোধ করে রাখা হয়। এর মাঝে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্য বার বনু কোরাইজা গোত্রকে ইসলাম গ্রহন করার অনুরোধ করেন। কিন্তু ইহুদীরা তাদের পূর্বধর্মেই অটল থাকে। ২৫ দিন পর যখন খানাপিনা শেষ হয়ে যায় তখন বনু কোরাইজা গোত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে প্রস্তাব দেয় তাদের মিত্র আওস গোত্রের হযরত সাদ ইবনে মুয়ায রাযিয়াল্লাহু আনহু যে ফয়সালা করবেন তাতেই তারা সম্মত আছে। হযরত সাদ ইবনে মুয়ায রাযিয়াল্লাহু আনহু ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের বিধান মতে যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে সকল পুরুষ ইহুদিকে হত্যা করা এবং ইহুদি নারীদের কে দাসী হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হোক এই রায় দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন নিঃসন্দেহে তুমি সঠিক ফয়সালা করেছ।

এরপরে বনু কোরাইজা গোত্রের ৪০০ পুরুষ ব্যক্তিকে একই দিনে হত্যা করা হয় এবং নারী ও তাদের সন্তানদের কে দাসি হিসাবে সিরিয়ায় বিক্রি করে দেয়া হয়। বনু কোরাইজা গোত্রের সর্দার কাব ইবনে আসাদ তার মৃত্যুর পূর্বে বলেন - “ বনী ইসরাইল গোত্র নবী ইয়াহিয়া আলাইহিস সাল্লাম এবং যাকারিয়া আলাইহিস সাল্লাম কে হত্যা করার শাস্তি আজ পেল। ” বনী কোরাইজা গোত্রের প্রতি এই কঠোর আচরনের ফলে মদীনার অন্যান্য ইহুদীরা আর কোনদিন ইসলামের সাথে শত্রুতা করার সাহস পায়নি। আর যদি এই কঠোর সিদ্ধান্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সময়ে না নিতেন তাইলে মদীনার অন্যান্য ইহুদী গোত্ররাও সময় সুযোগ মত আবার মুসলমানদের পিছন থেকে ছুড়ি মারার চেষ্টা করত। বনু কোরায়জা গোত্রের প্রতি তাওরাতের বিধান মতে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে আর কোনদিন মদীনার ইহুদীরা বাড়াবাড়ি করার সাহস পায়নি। আরব উপদ্বীপে শিশু ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে বনী কোরাইজা গোত্রের সাথে এই কঠোর আচরন করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাধ্য হয়েছিলেন।

[ তথ্যসূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিসাম, সীরাতুল মোস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আর রাহিকুল মাখতিম, নবীয়ে রহমত, মেশকাত শরীফের খন্দক যুদ্ধ অধ্যায় ]

No comments:

Post a Comment