Labels: ,

ইসলাম বনাম দাসপ্রথা: কিছু ভুল ধারনা এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান।

মুসলিম তারুণ্যের মনে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন বা সন্দেহ জাগাতে কমিউনিস্টদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে এই বিষয়টি। তারা বলে “ যদি ইসলাম মানবতার ধর্ম এবং সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য হতো তবে এটি দাস প্রথার অনুমোদন দিত না। এটি প্রমান করে যে ইসলাম সবসময়ের জন্য নয়। কেবল মাত্র অতিতের কিছু সময়ের জন্য এটি কার্যকারী ছিল , এটি তার লক্ষ্য অর্জন করেছে। বর্তমান সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়।

 “ আমাদের মুসলিম তরুণরা এই চক্রান্তের শিকার হয়। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে কেন ইসলাম দাস প্রথার অনুমোদন দেয়, এই ধর্মটি আল্লাহ্‌র প্রেরিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই, এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে এই ধর্মটি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবসময়ের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু ইসলাম কিভাবে দাসপ্রথা স্বীকার করে নেয়? যে ধর্মটি সবার জন্য সমান, যে ধর্মটি জাতী, বর্ণ, ধনী গরীব সবার জন্য একি জীবন ব্যবস্থার কথা বলে সেটা কিভাবে দাসপ্রথা অনুমোদন দেয় এবং এর জন্য আইন তৈরি করে? তবে কি আল্লাহ্‌ মানুষকে মালিক এবং দাস এই দুই পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন? তিনি কি চান কিছু মানুষকে দাস হিসেবে ক্রয় বিক্রয় করা হবে, পন্যের মত? কিন্তু তিনি নিজেই তো বলেছেন যে সব মানুষ আদম এবং হাওয়া হতে সৃষ্টি, সব মানুষ সমান।

যদি আল্লাহ্‌ মানুষে মানুষে বিভেদ পছন্দ না করেন তবে কেন তিনি এই প্রথা কোরআনে নিষিদ্ধ করেননি? এক কথায় আজকের মুসলিম তরুণরা জানে এবং বিশ্বাস করে যে ইসলাম সত্য ধর্ম, কিন্তু তাদের মনের কোনে মাঝে মাঝে এসব প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায়। অনেকটা কোরআনে বর্ণিত ইব্রাহিম (আঃ) এর কথামত।

 আর স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত করবে। বললেন; তুমি কি বিশ্বাস কর না? বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু দেখতে এজন্যে চাইছি যাতে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারি।আল কোরআন (২:২৬০)

কমিউনিজম মুসলিম তরুণদের মনে এসব সন্দেহের সৃষ্টি করে এবং এসব সন্দেহ পরিস্কার হবার সুযোগ না দিয়েই তাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে আসতে চায় যে, ইসলাম পুরনো এবং বাতিল জীবন ব্যবস্থা, এটি বর্তমান সময়ের সাথে খাপ খায় না।

কমিউনিস্টরা, যারা নিজেদের বিজ্ঞান্মনস্ক বলে দাবি করেন, মানুষকে বুঝাতে চায় যে তারা মানব সমাজের অমোঘ, অমোচনীয় সত্য আবিষ্কার করেছে যা কখনো সন্দেহ এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না। তারা প্রচার করে যে, মানুষের জীবন কিছু নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দশার মধ্যে দিয়ে গমন করে। এই দশা গুলো হচ্ছে ১ম কমিউনিজম, দাসপ্রথা, সামান্ততন্র, পুঁজিবাদ এবং ২য় কমিউনিজম ( যাকে মানব ইতিহাসের শেষ পর্যায় হিশেবে গণনা করা হয়)। তাদের মতে মানব ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, চিন্তা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ইত্যদি বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থার বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিফলন মাত্র। তাদের মতে শুধুমাত্র একটি জীবন ব্যবস্থাই সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না।
ইসলাম পৃথিবীতে এসেছিল এমন একটা সময়ে যখন দাসপ্রথা বিলুপ্ত হচ্ছিল এবং সামান্ততন্ত্র শুরু হচ্ছিল। ইসলাম নিজস্ব কিছু আইন কানুন, নিয়ম শৃঙ্খলা, জীবন বিধান নিয়ে আসলো যা পূর্বের এবং পরের ( দাসপ্রথা এবং সামান্ততন্ত্র) দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। এই কারনেই ইসলাম দাস প্রথা এবং সামান্ততন্ত্র দুটোকেই অনুমোদন দিয়েছিল। কারন ইসলাম অর্থনৈতিক উন্নয়নের কনো পর্যায়ের কথাও চিন্তা করেনি আবার এমন নতুন কোনো ব্যবস্থাও আনতে চায়নি যার সাথে মানুষ পুরোপুরি অবগত নয়।
২১ শতকের বর্তমান পৃথিবীতে দাড়িয়ে যদি কেউ এই দাসপ্রথা নিয়ে ভাবে তখন দাসদের উপর বর্বরতা অত্যাচার, দাসদের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার ( বিশেষ করে তৎকালীন রোমান সম্রাজ্যের চিত্র) এসব চিত্র তার চোখে ভেসে উঠবে। এসবকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করবে সে। সে ভাববে, কিভাবে ধর্ম এসব ব্যাপার অনুমোদন দেয়? কিভাবে ইসলাম শান্তির ধর্ম হয়েও এমন নিষ্ঠুর দাসপ্রথার অনুমোদন দেয় যেখানে ইসলাম মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির কথা বলে? এসব প্রশ্ন তাকে দ্বিধান্বিত করবে।

আসুন একটু ভাবি, ভেবে দেখি ইতিহাস এ সম্পর্কে আমাদের কি বলে। ইতিহাস যে নিষ্ঠুর, বর্বর দাসপ্রথার কথা বলে তার বেশিরভাগই রোমান সম্রাজ্যের, যা ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। রোমান সম্রাজ্যের সময়কালে দাসরা পন্য হিসেবে বিবেচিত হতো। তাদের মানুষ বলে গন্য করা হতো না। তাদের কোনো অধিকার ছিল না। তাদের যা আদেশ করা হতো তাই করতে তারা বাধ্য থাকত। তারা ছিল যুদ্ধবন্ধি। এসব যুদ্ধ কনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে হতো না। শুধুমাত্র রাজ্য জয় করে নিজের অধিকারে রাখার জন্য এসব যুদ্ধ হতো। এসব দাসরা রোমান জনগণের জন্য কাজ করত আর রোমানরা আরাম আয়েশে দিন কাটাত। দাসদের দিয়ে তারা ক্ষেত খামারে কাজ করাত। এসব কাজ করার সময় দাসদের পায়ে শিকল বাঁধা থাকত যাতে তারা পালিয়ে যেতে না পারে। তাদের উপযুক্ত পরিমান খাদ্য দেয়া হতো না। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই দেয়া হতো খেতে।

রোমানরা ভাবত যে দাসরা অন্যান্য পশুপাখির মত শুধুমাত্র তাদের সেবা করার জন্যই জন্মেছে। দাসদের থাকার জায়গা হতো অন্যান্য গৃহপালিত পশুর সাথে অন্ধকার এবং দুর্গন্ধময় স্থানে। রোমানদের মনোরঞ্জনের জন্য দাসদের হিংস্র পশুর সাথে লড়াইয়ে নামতে হতো যা রোমানদের কাছে খেলা হিশেবে বিবেচিত হতো। শুধু রোমান সম্রাজ্যই নয়, পারস্য, ভারত এবং অন্যান্য দেশেও দাসদের ভাগ্য প্রায় একিই রকম ছিল। দাসদের জীবনের কনো মূল্য ছিলনা। তাদের হত্যা করা অপরাধ হিশেবে গন্য করা হতো না।

পৃথিবীর অবস্থা এমনই ছিল যখন ইসলাম দৃশ্যপটে আসে। ইসলাম তখন মানবতার বানী নিয়ে আসে। ইসলাম মালিক ও দাস উভয়কেই একথা বলে “ তোমরা উভয়ই সমান। যে তার দাসকে হত্যা করবে আমরা তাকে হত্যা করব। যে তার দাসের নাক কর্তন করবে আমরা তার নাক কর্তন করব। যে তার দাসের সাথে ভাল ব্যবহার করবে আমরা তার সাথে ভাল ব্যবহার করব।

ইসলাম বলে মানুষে মানুষে কনো ভেদাভেদ নেই।ইসলাম বলে “
 "And be good to the parents and to the near of kin and the orphans and the needy neighbor of (your) kill and the alien neighbor and the companion in a journey and the wayfarer and those whom your right hand possesses; surely Allah does not love him who is proud, boastful" (iv: 36).” 

“Your slaves are your brothers..so he who has a brother under him should feed him and clothe him as he himself feeds and dresses; do not ask them to do things which are beyond their power and if you do ask them to do such things then help them (Al-Hadith.)".


ইসলাম প্রথমে দাসের প্রতি মালিকদের আচরন এবং ব্যবহার বদল করতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করে দাসদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদল করতে। এর ফলে দাসরা আর ব্যবসার বস্তু বা পন্য হিশেবে বিবেচ্য হল না। তারা তার মালিকের মতই মানুষ হিসাবে বিবেচ্য হতে থাকল। ইসলাম প্রথমে দাস এবং মালিকের মধ্যে সম্পর্ককে ভাতৃত্বে বদল করল। তারপর পর্যায়ক্রমে দাসদের মুক্তির কথা বলল। ইউরোপের অনেক বিখ্যাত লেখক এবং পণ্ডিত ইসলামের এই সফলতা স্বীকার করে নেয় এবং এর প্রশংসা করে। ইসলামের এই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে দাসরা আস্তে আস্তে মালিকের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে পড়ল।

মহানবী (সঃ) মুসলিমদের দাসদের সাথে আদেশের সূরে কথা বলতে নিষেধ করেন। তিনি তাদের সাথে নম্র ভাষায় কথা বলতে বলেন যাতে তারা নিজেদের ঐ পরিবারের একজন মনে করতে পারে এবং তাদের হীনমন্যতা দূর করতে পারে। তিনি বলেন “ নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমাকে তাদের মালিক বানিয়েছেন। যদি তিনি চান তবে তুমি তাদের পর্যায়ে থাকতে পার। “ ইসলাম মালিক এবং দাসদের মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। ইসলাম দাস ও মালিকদের মধ্যে সমান অধিকারের কথা বলে।

ইসলামের প্রথম পর্যায়ে দাসদের অধিকার, দাসদের প্রতি ব্যবহার, সমাজে দাসদের অবস্থান ইত্যদি ব্যাপার সঠিক করে। কিন্তু শুধু এতেই থেমে থাকেনি। প্রথমে দাসদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদল করে। এরপর ক্রমান্বয়ে তাদের মুক্তির পথে এগোয়। দুটি পদ্ধতিতে এই দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় বের করে ইসলাম।

এই পদ্ধতি দুটি হচ্ছেঃ 
১। মালিকদের স্বেচ্ছায় তাদের অধিনস্ত্য দাসদের মুক্তি দানে উৎসাহ প্রদান। (Al Itq)
২। লিখিত চুক্তির মাধ্যমে। (Mukatabah),


প্রথম পদ্ধতিতে ইসলাম মালিকদের কোনরূপ শর্তারোপ না করে দাস মুক্তি দিতে উদ্বুদ্ধ করে। এক্ষেত্রে প্রথমেই মহানবী (সঃ) তাঁর অধিনস্ত সব দাসদের মুক্তি দেন। সাহাবীরাও তাকে অনুসরন করেন। আবুবকর (রাঃ) প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন মালিকদের কাছ থেকে দাস ক্রয় করতে এবং পরে তাদের মুক্তি দেন। মহানবী (সঃ) বদর যুদ্ধের বন্ধীদের এই শর্তের দ্বারা মুক্তি প্রদান করেন যে, যদি তাদের প্রত্যকে ১০ জন মুসলিমকে লেখতে এবং পড়তে বা অন্য কোন উপকারে আসতে পারে তবে তারা মুক্ত। ইসলাম সে সময় ভুলবশত কনো লোকের হত্যার প্রায়শ্চিত্ত হিশেবে একজন দাসকে মুক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে জরিমানা স্বরূপ অর্থ দেয়ার আইন প্রনয়ন করে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে ঐ সময়ে বা এর পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সময়ে আর কনো জাতীতে এত প্রচুর সংখ্যক দাস মুক্তির ঘটনা ঘটেনি যেমনটা ইসলামের অধিনস্ত জাতি সমুহে হয়েছিল। তাই ইসলামকে বলা হয় মানবতার ধর্ম।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ইসলাম মালিক এবং দাসদের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তির মাধ্যমে দাস মুক্তির ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে দাসরা তার মালিকের সাথে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ যোগানের চুক্তিতে মুক্তি লাভ করে।দাস যখনি চুক্তির পরিমান অর্থ মালিককে দিতে পারবে তখনই মালিক তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য থাকবে। নতুবা দাস এর প্রতিকার চাইতে পারবে বিচারালয়ে। যে সময় কোনো দাস মুক্তির দাবি করবে নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে, সে সময় থেকে মালিক দাসের কাছ থেকে অর্থের সমপরিমাণ কাজ আদায় করতে পারে অথবা দাসকে বাহিরে অন্যান্য কাজ করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দিতে বাধ্য থাকবে। ঠিক এই নিয়মটিই ইসলামের নিয়ম চালু হওয়ার ৭০০ বছর পর ১৪০০ শতকে ইউরোপে দাস মুক্তির ক্ষেত্রে চালু হয়েছিল। ইসলাম এই আইন করে ঐসব দাসদের মুক্তির উপায় করে দেয় যারা মালিকের দয়ার জন্য অপেক্ষা না করে নিজ উদ্যেগে মুক্তি পেতে ইচ্ছুক। শুধু তাই নয়, ইসলাম এমন দাসদের সাহায্যের জন্য যাকাত বা বায়তুল মাল থেকে অর্থ দানের ব্যবস্থা করে। এভাবে আস্তে আস্তে ইসলাম তৎকালীন সমাজ থেকে দাস প্রথার বিলোপ ঘটিয়েছিল। ইসলামের এই মহৎ এবং মানবিক নিয়মগুলো পরবর্তীতে ইউরোপে দাস মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভাবক হিশেবে কাজ করেছিল, যা অনেক বিখ্যাত পণ্ডিত তাদের লেখায় স্বীকার করে গেছেন।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে কেন ইসলাম মানবতার ধর্ম হয়েও এত পর্যায়, পদ্ধতি এবং সময় নিল, মালিকদের বিনা শর্তে তাৎক্ষনিক দাস মুক্তির আদেশ না দিয়ে? এর উত্তরের জন্য আমাদের তখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করতে হবে। যখন ইসলাম আসলো তখন দাসপ্রথা পুরো পৃথিবীর সমাজ এবং অর্থনীতির আবিচ্ছেদ্য অংশ হিশেবে বিবেচিত হতো। খুব কম লোকই তখন এর খারাপ দিক নিয়ে ভাবত বা এর বিলোপের কথা ভাবত। তাই দাসপ্রথা বিলোপের আগে দাসদের প্রতি সমাজ এবং মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। তাই ইসলাম প্রথমে সমাজে দাসদের অবস্থান এবং অধিকার সমুন্নত করার পদক্ষেপ নেয়। এরপর আস্তে আস্তে তা বিলোপ করার দিকে অগ্রসর হয়। তাই ইসলামে এই প্রথা বিলোপ করতে মহানবীর জীবনকাল থেকেও বেশি সময় লেগেছিল।

যেহেতু তাঁর জীবনকালেই কোরআন অবতীর্ণ হয় সে কারনেই কোরআন এবং হাদিসে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে কোনো কথা নেই। কিন্তু এটি থাকবেই বা রাখতেই হবে এমন কিছুও বলা নেই। বরং দাসদের মুক্তির কথাই বলা হয়েছে অনেকবার। সে কারনেই মহানবীর মৃত্যুর কিছু সময় পর ইসলামী বিশেষজ্ঞরা একত্রিত হয়ে দাস প্রথা নিষেধের আইন প্রণয়ন করেন। এতে কোরআনের বা হাদিসের কোনো কথার বিরুদ্ধে যাওয়া হয়নি। এই ঐক্যমতের ভিত্তিতে ইসলামী আইন বা নিয়ম সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার পদ্ধতি কেই ইজমা বলা হয়। ঠিক একই রকম ব্যাপার ঘটে মদ্যপানের নিষেধের আইনের ক্ষেত্রেও। কোরআনে প্রথমে মদ্যপানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হয় এবং একে এড়িয়ে যেতে বলা হয়। এরপর যখন উপযুক্ত সময় আসলো তখন কোরআনে মদ্য পান হারাম বলে আয়াত নাযিল হলো। আল্লাহ্‌ তখনিই নিসেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন যখন উপযুক্ত সময় এসেছিল। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ। যদি মহানবীর জীবনকালেই তৎকালীন সামাজিক অবস্থা উপযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছাত তখন আল্লাহ্‌ অবশ্যই কোরআনে দাস প্রথা নিষেধ করে দিতেন।


যখন আমরা বলি ইসলাম সকল মানুষের এবং সকল সময়ের জন্য এবং এটি সব ভাল এবং সুন্দর জিনিস গ্রহন করে যা সুস্থ এবং সুন্দর জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় তখন এই কথাটি দ্বারা এটা বুঝানো হয় না যে এতে সবসময়ের সব কিছু, সকল রিতিনিতি বলা আছে। এমনটা কখনোই নয়। ইসলামে ঐসব ব্যাপারের পুংখানপুঙ্খ বিবরন এবং দিকনির্দেশনা দেয় যেসব মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ব্যাপারগুলো সবসময়ের জন্যই প্রযোজ্য এবং অপরিবর্তনীয়। ইসলাম মানুষের ঐসব গুরুত্বপূর্ণ অপরিবর্তনীয় ব্যাপার গুলোর নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়। ইসলাম চেয়েছে মানুষকে কিছু সাধারণ দিকনির্দেশনা দিতে যার দ্বারা মানুষ ভবিষ্যতের উন্নতির পরিকল্পনা করতে পারে। ঠিক এই ব্যাপারটিই করেছে ইসলাম দাসপ্রথার ক্ষেত্রে। এটি প্রথমে দাসদের অধিকার সমুন্নত করে এবং পরবর্তীতে দাসদের মুক্তির পথ ঠিক করে দেয় যাতে নিকট ভবিষ্যতে এই নিষ্ঠুর প্রথা সমূলে উৎপাটিত হয়।

ইসলাম কোনো যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় মুহূর্তেই সমস্যা দূর করেনি। একটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছে যাতে মানুষ আস্তে আস্তে সভ্য এবং সুন্দর জীবন লাভ করে। ইসলামের এই শিক্ষা আমাদের অনেক তথাকথিত ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো জানেন না বা মেনে চলেন না। তারা চান হথাত করে সমাজে ইসলামী নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠা করতে। হঠাত পরিবর্তন ঘটাতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। জোর করে কোনো মানুষকেই নিয়ম কানুন মেনে চলতে বাধ্য করা যায় না। মানুষকে আগে ইসলামের লক্ষ্য,উদ্দেশ্য এবং সুফল সম্পর্কে অবগত করতে হবে যাতে মানুষ নিজে থেকেই তা গ্রহন করে। এরপর আসে আইন কানুনের প্রচলন যা মানুষকে তার কু প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। কিন্তু এই ব্যাপারটি আমাদের অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না। উনারা চান হঠাত পরিবর্তন।

যদি এমনটাই হতো তাহলে আল্লাহ্‌ অবশ্যই আল্লাহ্‌ নিজেই মানুষের মনকে ভাল করে দিতেন যাতে মানুষ খারাপের সংস্পর্শে না আসতে পারে। তিনিই সেই ক্ষমতার অধিকারী, সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ। কিন্তু তিনি কখনোই তার সৃষ্ট নিয়মের বাহিরে যেয়ে কিছু করেন না। তাই ইসলাম প্রথমে সমাজকে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে যার ফলে পরবর্তীতে ইসলামে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর সাহাবীরা এমন সব অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে দাস প্রথা বিলপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইসলাম সমাজ থেকে দাস প্রথা দূর করার সাথে সাথে মানুষের মন থকেও এই প্রথা দূর করেছিল। ইসলাম আব্রাহাম লিংকনের মতো শুধুমাত্র আদেশ যারি করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। এমন ব্যবস্থা করেছে যাতে দাসরা সমাজের এবং রাষ্ট্রের একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্টিত এবং পরিগণিত হয়। তারা যাতে সমাজের সাধারণ মানুষের মতই অধিকার ভোগ করে সে ব্যবস্থাই করেছে ইসলাম।

কিন্তু এতসব কিছুর পরও ইসলামের সমালোচকরা ইসলামে দাসপ্রথার অনুমোদন নিয়ে সমালোচনায় ব্যাস্ত থাকে।তারা এটা জানেনা বা জানলেও স্বীকার করেনা যে ইসলাম ইউরোপের ৭০০ বছর পূর্বে দাস প্রথাকে সমূলে উৎপাটন করেছিল। কারন তাদের ধারনা অনুযায়ী, ইসলামের প্রশংসা করা মানেই তো পুরনো ধ্যান ধারণার অনুসারী হয়ে যাওয়া, আধুনিক সমাজ থেকে ছিটকে পরা বা তথাকথিত আধুনিক মানুষদের চোখে হাস্যকর হওয়া। আবার তারাই জোর গলায় বলেন তারা নাকি সত্যের পূজারি। সত্যিই অদ্ভুত। যা সত্য তা সত্যই থাকবে। যতই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হোকনা কেন। আল্লাহ্‌ কোরআন এবং ইসলামের সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এর রক্ষাকর্তা। এবং একসময় এসব মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ইসলাম জয়ী হবেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ধন্যবাদ সবাইকে এত বড় একটি লেখা পড়ার জন্য। আমি যথাসম্ভব ছোট করার চেষ্টাই করেছি যাতে সংক্ষেপে কথা গুলো বলা যায়।

Written by-মেহেদী আনোয়ার

No comments:

Post a Comment