Labels: , ,

মানসিক যন্ত্রণা থেকে আরোগ্য লাভের উপায়

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

وَأَصْبَحَ فُؤَادُ أُمِّ مُوسَى فَارِغًا إِن كَادَتْ لَتُبْدِي بِهِ لَوْلَا أَن رَّبَطْنَا عَلَى قَلْبِهَا لِتَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
বাংলা ভাবার্থঃ “ওদিকে মূসার মায়ের মন অস্থির হয়ে পড়েছিল। সে তার রহস্য প্রকাশ করে দিতো যদি আমি তার মন সুদৃঢ় না করে দিতাম, যাতে সে (আমার অঙ্গীকারের প্রতি) বিশ্বাস স্থাপনকারীদের একজন হয়”। [সুরা কাসাস ২৮:১০]
English Translation: “And the heart of Moses' mother became empty [of all else]. She was about to disclose [the matter concerning] him had We not bound fast her heart that she would be of the believers”. [28:10]


এই আয়াতটি কুরআনের বিশতম পারা থেকে নেয়া।  সুরা কাসাসের এই আয়াতটি আমার প্রিয় আয়াতসমুহের মধ্যে একটি। মুসা (আঃ) এর মায়ের বিষয়ে  এই আয়াতটিতে আলোচনা করা হয়েছে।


জীবনের বিভিন্ন সময় আমরা সবাই বিভিন্ন মাত্রার মানসিক কষ্টের মুখোমুখি হই। প্রচণ্ড মনোকষ্টের ভেতর সময় অতিবাহিত করি। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে বুকের ভেতর কাঁটা বিঁধে থাকার মত কষ্ট অনুভুত হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে, প্রিয়জনের দুরারোগ্য রোগে (যখন শুধু চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখি কিন্তু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না), যখন বাবা-মা সন্তানকে বা সন্তান বাবা-মাকে ভয়ঙ্কর সব কথা বলে, যখন স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে জঘন্য কথা বলে বা পরস্পরের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে, বন্ধু শত্রুর মত ব্যবহার করে, অনেক আদরের ও দীর্ঘদিনের বিশ্বাসী কেউ চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে --- তখন জীবনটাকে দুর্বিষহ মনে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ঘটনায় যেমনঃ চাকুরী হারানো, সন্তান হারানো, রাতারাতি সহায়-সম্পত্তি-অর্থ-খ্যাতি হারিয়ে পথে চলে আসা, সম্ভ্রম হারানো ইত্যাদি মানুষের আবেগকে চরমভাবে আঘাত করে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে কত শত মানুষ কি অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক কষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা,  প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয় ও আতংকের ভেতর সময় কাটাচ্ছে যা আমাদের কল্পনার বাইরে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা কি ভয়াবহ পরিবেশে জীবন কাটাচ্ছে, কি নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করা হচ্ছে --- যা আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা। এই হচ্ছে বাস্তবতা যা আমরা প্রতিদিন দেখছি, কখনো এর ভেতরে থেকে আবার কখনো দর্শক হিসাবে। এই আয়াতটি এইসকল আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য একটি আশার বানী বহন করে। কারণ, মানুষ যখন মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পরে, তখন সে ভাবে এই অবস্থা থেকে আমার কোন মুক্তি নাই, কোনভাবেই এই কষ্ট কাটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না --- সেই ধরনের পরিস্থিতিকে কাটিয়ে ওঠার জন্য এই আয়াতটি একটি দিক নির্দেশনা দেয়।
 
মুসা (আঃ) এর মাকে আল্লাহ্‌‘তালা এমন একটি অসামান্য কঠিন কাজ দিয়েছিলেন, যা কিনা যেকোন মায়ের পক্ষে এককথায় অকল্পনীয়। তাঁর নবজাতক সন্তানকে ‘বাঁচানোর’ জন্য পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে। তাঁর সামনে শুধু দুটো রাস্তা খোলা ছিল।

এক. চোখের সামনে ফেরাউনের সৈন্যদের হাতে নিজ সন্তানের হত্যা দেখা

দুই. আল্লাহ্‌র নির্দেশে শিশু মুসা (আঃ) কে ঝুড়িতে করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া

 একটা সাধারণ ঝুড়ি, ওয়াটারপ্রুফ বা নেভিগেশনের ক্ষমতাযুক্ত নয়। নিজের নবজাতক সন্তানকে এমন একটি ঝুড়িতে ঢুকিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে, সেই ঝুড়ি উলটে বাচ্চা পানিতে ডুবে যেতে পারে, তাকে নদীর হিংস্র প্রাণীরা খেয়ে ফেলতে পারে, ফেরাউনের সৈন্যরা তাকে দেখে তুলে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে --- এই নাড়িছেঁড়া সন্তানকে আর কখনো দেখতে পারবে না, আদর করে বুকে জড়িয়ে তাঁর গায়ের গন্ধ নিতে পারবে না। এই সকল চিন্তা সম্ভবত একসাথে তাঁর মাথায় উঁকি দিচ্ছিল। চোখের সামনে ফেরাউনের সৈন্যদের হাতে নিজ সন্তানের হত্যা দেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না ভেবেই তিনি নিরুপায় হয়ে বুকে পাথর চেপে শিশু মুসা (আঃ) কে নীল নদের পানিতে ভাসিয়ে দিলেন। মুসা (আঃ) এর মা যখন আল্লাহ্‌র ইশারায়  এ কাজ করেছিলেন (কারণ আল্লাহ্‌র সাহায্য ছাড়া এই ধরনের কাজ করা অসম্ভব), এই আয়াতটিতে আল্লাহ্‌ সেই মুহূর্তটি বর্ণনা করে বলছেন, “ওয়াআছ্ববাহা ফুআ-দু উম্মি মূসা- ফা-রিগান”, মূসার মায়ের মন থেকে আবেগ ও চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। কোন মানুষ যখন মানসিকভাবে চরম আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন সে কিছু সময়ের জন্য একেবারে আবেগশুন্য হয়ে যায়। তার চোখের দৃষ্টি শুন্য হয়ে যায়, যদি তার চোখের সামনে দিয়ে হাত নাড়া হয় তবুও তার চোখের পলক পরে না, তার চিন্তাশক্তি এতোটাই লোপ পায় যে তার আশেপাশের কোন কিছুতেই সে আর প্রভাবিত হয় না। নির্বাক হয়ে শুন্যদৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে। এই অবস্থাটিকে বলা হয়েছে ‘ফা-রিগান’। “ইন কা-দাত লাতুবদী বিহী”, অর্থাৎ 'সে তো তাঁর (মুসার) পরিচয় প্রকাশে প্রায় উদ্যত হয়েছিলো'। আরেকটু হলেই তিনি চিৎকার করে বলেই দিচ্ছিলেন যে, “আমার বাচ্চা!  আমার বাচ্চা!! তাকে বাঁচাও!!!” কিন্তু এটা যদি তিনি করতেন তাহলে ফেরাউনের নিষ্ঠুর সৈন্যরা তাঁর সন্তানকে মেরে ফেলতো।  এখানে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “লাওলা আর্ রাবাত্বনা- ‘আলা- ক্বালবিহা”, অর্থাৎ ‘যদি আমি তার মন সুদৃঢ় না করে দিতাম’। মুসা (আঃ) এর মায়ের অন্তরজ্বালা (ফু’আদ) কে আল্লাহ্‌‘তালা অবদমিত করে তাঁর হৃদয়কে শান্ত ও অবিচল করেছিল। এখানে এই অর্থে ‘ক্বালব’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ এই আয়াতে বলছেন যে তিনি এই কাজটি করেছেন। “লিতাকূনা মিনাল্ মুমিনীন",  ‘যাতে সে (আমার অঙ্গীকারের প্রতি) বিশ্বাস স্থাপনকারীদের একজন হয়’।


অনেকেই আছেন যারা মানসিকভাবে অসম্ভব আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর কোন অবস্থাতেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। তারা মানসিকভাবে এতোটাই ভেঙে পরে যে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি চিরতরে লোপ পায়। কেন তারা পারে না? কারণ, আল্লাহ্‌ তাদের মন কে সুদৃঢ় করেন না। চরম মানসিক আঘাতের পর হৃদয়কে শান্ত ও অবিচল করে আবার স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করা, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা -– একমাত্র আল্লাহ্‌র সাহায্য ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয় নি। আমরা যাকে মনের জোর বলি, সেটা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সাহায্যেই অর্জন করা সম্ভব। হৃদয়ের ক্ষতচিহ্ন আরোগ্য করার ক্ষমতা শুধু আল্লাহ্‌র কাছেই আছে। এবং আল্লাহ্‌ কখন সেটি করেন? যখন বান্দা এক আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনে, আস্থা প্রকাশ করে অবিচল থাকে। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনার ফলাফলস্বরূপ আল্লাহ্‌র তরফ থেকে যে সাহায্য-শক্তি-সাহস পাওয়া যায় তার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা হয় না।

 কোন মায়ের পক্ষে তার সন্তানকে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ্‌‘তালা মুসা (আঃ) এর মায়ের হৃদয়কে এতোটাই শান্ত করে দিয়েছিলেন যে তিনি যে শুধু নিজের আবেগের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিলেন তাই নয়, বরং তিনি এই পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে মুসা (আঃ) এর বোনকে বাচ্চার পেছনে পেছনে যাবার নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন।  সন্তানের থেকে বিচ্ছেদের ফলে, তাঁর হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো।  কিন্তু তাঁর ছিলো আল্লাহ্‌র কল্যাণকর পরিকল্পনার উপরে অগাধ বিশ্বাস।আল্লাহর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। সেই সময় পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারণের প্রয়োজন হয়। ফলে আল্লাহ্‌ মুসা (আঃ) এর মায়ের হৃদয়ে ধৈর্য্য ধারণের ক্ষমতা দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। আল্লাহ্ পরম করুণাময়।


সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, মুসা (আঃ) এর মা আমার-আপনার মত সাধারণ মানুষ ছিলেন, কোন নবী-রাসুল ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় ঈমানের বিশ্বাসী নারী। শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের কারনেই তাঁর পক্ষে এই অকল্পনীয় কাজ করা সম্ভব হয়েছিল। তাই জেনে রাখুন, আপনি যে কোন মাত্রার মানসিক আঘাত, ব্যথা, বা যন্ত্রণায় ভুগছেন না কেন, যদি আল্লাহ্‌র উপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকে, তাহলে আল্লাহ্‌ আপনার এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অবশ্যই হস্তক্ষেপ করবেন। ফলশ্রুতিতে আপনার মন ও হৃদয়ে শান্তি আসবে ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন। আল্লাহ্‌র সূদূর প্রসারী পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা কি ভাবে কাজ করে তার অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মুসা (আঃ) এর কাহিনীর মাধ্যমে এই চিরন্তন সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাই কোন দুর্যোগ বা বিপদে ধৈর্য্যহারা না হয়ে আল্লাহ্‌র প্রতি ভরসা রেখে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। আজ যা বিপদের কালো মেঘ, আগামীতে তাই-ই হয়তো সফলতার স্বর্ণ উজ্জ্বল দিন হয়ে দেখা যাবে যার খবর শুধু আল্লাহ্‌-ই জ্ঞাত।


আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে তাঁর উপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে সব ধরনের বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণের ক্ষমতা দিক। কঠিন সময়ে আমাদের মন ও হৃদয়ে শান্তি দান করুন। আল্লাহ্‌র সহায়তায় আমরা যেন বিপদে নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।



[নোমান আলী খানের কুরানিক জেমস (Quranic Gems) সিরিজের বিশতম পর্বের বাংলা ভাবার্থ। দ্রুত অনুবাদ করার কারনে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুল আশাকরি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যা কিছু কল্যাণকর তার সম্পূর্ণই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে, আর যা কিছু ভুল সেটি সম্পূর্ণ আমার। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমার সেই ভুলগুলো মার্জনা করুন। তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। আল্লাহ্‌তালা আমাদের সকলকে কুরআনের আয়াতসমূহ বুঝে পড়ার তৌফিক দান করুন এবং  সঠিক মর্মার্থ বুঝে সেই ভাবে জীবনকে পরিচালিত করার মত হিকমাহ, সাহস ও ধৈর্য দিক।]


(To watch the video go to: https://www.youtube.com/watch?v=DzSDr5xiGIE)

No comments:

Post a Comment