Labels: , ,

‘জিহাদী মুসলিম’

"তুই ঐ কাফির নাছারাদের দেশে পড়ে আছিস কেন?"

অ্যামেরিকাপ্রবাসী জাকির অফিসের কাজের ফাঁকে বাংলাদেশনিবাসী বন্ধু সোহেলের সাথে চ্যাট করছিল।
বন্ধুর কথায় সে একটু নড়েচরে বসে।

"কেন বন্ধু? এই দেশে সমস্যা কী? ওরাতো আমার দাড়ি শেভ করতে বলছে না। আমার স্ত্রীকে হিজাব পড়তে নিষেধ করছে না। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তে কেউ বাঁধা দিচ্ছে না। এমনকি কাজ থেকে ব্রেক নিয়ে জুম্মার নামাজ পড়তেও আমার কোন সমস্যা হয়না। ঠিকঠাকমত রোজা রাখতে পারি, ঈদের জামাতও মিস হয়না। তাহলে শুধু শুধু ওদের গালি দিব কেন?"

সোহেল বোধয় জবাব শুনে হাসলো। সে লিখলো, "আমাদের মুসলমানদের এই এক সমস্যা। অল্পতেই খুশি। গাধার সামনে মূলা ধরার মতন। আরে, ওরা যে আমাদের মুসলিম ভাইদের মেরে সাফ করে দিচ্ছে, ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ধ্বংস হয়ে গেল, এসব কিছুই তোদের চোখে পড়েনা? শুধু জামাতে নামাজ পড়তে দিয়েছে বলেই খুশিতে লেজ নাড়তে শুরু করে দিয়েছিস? নাইন ইলেভেনে তোদের বুক পুড়ে, অথচ গাজায় যে প্রতিদিন নাইন ইলেভেন হচ্ছে, সে নিয়ে তোরা নিরব। ধিক তোদের ঈমানে!"

জাকিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। একটা জরুরি ফাইল নিয়ে কাজ করছিল। আপাতত ফাইলটা ক্লোজ করে রাখলো। সোহেলকে কিছু কথা না শোনালে ঠিকমতন মনোযোগ দিতে পারবেনা।

"তোর ফোন নম্বরটা দে।"
"কেন?"
"কথা আছে।"
সোহেল নম্বর দিল।
জাকির অফিস ম্যাসেঞ্জারে 'ইন আ মিটিং' স্ট্যাটাস দিয়ে ডেস্কটপ লক করে ব্রেক রুমে চলে এলো।
"হ্যালো।"
"হ্যালো বন্ধু, কি ব্যপার? হঠাৎ ফোন দিলি যে?"
"তোর সাথে কথা বলার জন্য। চ্যাটে টাইপ করলে কথাগুলি ভালমত এক্সপ্লেইন নাও করতে পারি।"
"এতে এক্সপ্লেইন করার কী আছে?"
সোহেল জাকিরের কথা উড়িয়ে দিল।

"বিদেশে গিয়ে আরাম আয়েশে থেকে তোরা দ্বীনের রাস্তা থেকে সরে গেছিস। মুসলিম মায়ের অশ্রুতে তোদের কলিজা কাঁপে না, মুসলিম ভাইয়ের রক্তে তোদের চোখ ভিজে না। তোরা দামী গাড়ি, দামী বাড়িতেই সুখী। আর অন্যদিকে ইরাকে আমাদের মুজাহিদ ভাইয়েরা দ্বীনের জন্য প্রাণ দিচ্ছে। জিহাদ চলছে ফিলিস্তিনে, আফগানিস্তানে, কাশ্মিরে, পাকিস্তানে। আর তোরা ইসলামের দুশমনদের গোলামী করছিস!"
জাকির বলল, "তোকে একটা গল্প শুনাই। সহীহ হাদিস। হুনেইয়ের যুদ্ধের ঘটনা।"
সোহেল উদাস স্বরে বলল, "শোনা..."

সোহেলের কন্ঠস্বরে মনে হলো সে শুনতে আগ্রহী না। তবু জাকির শুরু করলো,
"হুনেইয়ের যুদ্ধ জয়ের পর রসূলুল্লাহ (সঃ) যখন গণিমতের মাল বন্টন করছিলেন, তখন এক আরব বেদূইন এসে সরাসরি তাঁকে এই বলে অভিযুক্ত করে যে তার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। রাসূল (সঃ) ন্যায্য দাবী আদায়কারী নন। সে নবীজির(সঃ) নাম উচ্চারণ করে বলেছিল,“আল্লাহকে ভয় পান, এবং ন্যায় বিচার করুন!”
"আস্তাগফিরুল্লাহ!"
সোহেল ক্ষেপে গিয়ে ইস্তেগফার করে উঠলো।

জাকির বলল, "ঠিক। রাসূলের (সঃ) সাথেকার সাহাবীরাও তোর মতই রেগে উঠেছিলেন। কিন্তু নবীজি (সঃ) ধৈর্য্যের সাথে বললেন, 'খোদ বিশ্বজাহানের মালিকের যেখানে আমার বিচারের উপর আস্থা আছে, সেখানে তুমি আমাকে অন্যায়কারী বলছো?'"
বেদূইন নবীজিকে(সঃ) গালাগালি করে চলে গেল।

সাহাবীরা চাইলেন লোকটিকে উপযুক্ত সাজা দিতে। নবীজি (সঃ) বললেন, "ওকে যেতে দাও। ওকে হত্যা করলেও ভবিষ্যতে ওর মতই আরও অনেকে আসবে। তাদের দেখলে খুব ধার্মিক বলে মনে হবে, কিন্তু আসলে তারা পথভ্রষ্ট। আমার জীবিতাবস্থায় তারা যদি আত্মপ্রকাশ করে, তবে আমিই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো, এবং তাদের সেভাবেই ধ্বংস করবো, যেভাবে আদ্ব জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করেছিলেন। তোমরা তাদের থেকে সাবধান থেকো।"
নবীজি (সঃ) এরকম দশটিরও বেশি সহিহ হাদীছে তাদের বিরুদ্ধে সাবধান করে গেছেন। কেন? কারন তারা কাফেরদের চেয়েও ইসলামের বেশি ক্ষতি করবে।"

সোহেল বলল, "তুই কী বলতে চাস?"
জাকির বলল, "বলছি, তবে তার আগে তোকে আরেকটা ইসলামী ঘটনা শুনাতে চাই। তোর সময় আছেতো?"
সোহেল বলল, "কোরআন হাদীছে শোনার সময় হবেনা? কী ভাবিস তুই আমাকে?"
"গ্রেট! হযরত আলী(রাঃ) এবং মোয়াবিয়ার মধ্যকার কনফ্লিক্টের ঘটনা তুই জানিস?"
"জানবোনা কেন?"

"গুড! তাঁদের মধ্যকার আসল ঝামেলাটা ছিল রাজনৈতিক, ইসলামিক নয়। কাজেই হযরত আলী (রাঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন দুইনেতা একসাথে বসে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবেন। এতে সাধারণ মুসলিমরা খুশি হলেও ছয় হাজার মুসলমানের একটা দল হযরত আলীকে(রাঃ) গালাগালি দিয়ে দলত্যাগ করলো। তাদের দাবী ছিল, হযরত আলী(রাঃ) মোয়াবিয়ার সাথে শান্তি স্থাপনের আলোচনায় রাজী হয়ে ইসলামের পথ থেকে সরে গিয়েছেন। মানুষ কোন সমস্যার সমাধান করতে পারবেনা, শুধুমাত্র কুরআনের সেই অধিকার আছে।"

ওরা এতটাই ধর্মান্ধ হয়ে গিয়েছিল যে তারা ইসলামের চুতুর্থ খলিফাকে 'কাফির' গালি দিতেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনি।
ওদের একজনতো আবার প্রস্তাব করেছিল আলীকে (রাঃ) হত্যা করবে!"
সোহেল এবারে গালি দিল।

জাকির বলল, "কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) কী করলেন? তাদের যেতে দিলেন। বললেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের মসজিদ বানাও, নিজেদের মত ধর্ম পালন কর। আমাদের কারও ক্ষতি না করা পর্যন্ত তোমাদের কোন ক্ষতি আমরা করবো না।’ পয়েন্ট হচ্ছে, হযরত আলীও (রাঃ) কিন্তু নবীজির (সঃ) মতন তাদের যেতে দিয়েছেন। হত্যার হুকুম দেন নাই।"

সোহেল বলল, "তারপর কী হলো?"
"ওরা আলাদা হয়ে গেল। ওরাই ইসলামের প্রথম ভাঙ্গন ঘটায়। শিয়া-সুন্নি ভেদেরও আগে তারাই মুসলমানদের মধ্যে প্রথম বিভক্তি টানে। হযরত আব্বাস (রাঃ) পরে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের সাথে পথভ্রষ্ট এক তৃতীয়াংশ লোককে ফিরিয়েও আনতে সক্ষম হন। কিন্তু আরও চার হাজার লোক ঠিকই থেকে যায়।"
"তারা কী করে?"

এবারে সোহেলের কন্ঠে কৌতূহল টের পাওয়া যায়।
জাকির বলে, "তারা হযরত আলীর (রাঃ) সাথে থেকে যাওয়া মুসলিমদের সমালোচনা করতে থাকে। বিদ্রুপ করতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় হ্যারাসও করতে থাকে। একবার তারা একজন সাহাবীকে স্বপরিবারে জবাই করে হত্যা করে। কারন? তিনি বলেছিলেন, ‘হযরত আলী (রাঃ) নিঃসন্দেহে আমার এবং তোমার চেয়ে ধর্ম বেশি ভাল জানেন।’"
সোহেল এইবারও গালি দেয়।

জাকির বলে, "মজার ব্যপার কি জানিস? সাহাবী হত্যা করে ফেরার পথে দলের একজন একটি বাগানের আঙ্গুর গাছ থেকে বিনা অনুমতিতে একটি আঙ্গুর পেড়ে খেয়েছিল, এবং আরেকজন একটি খৃষ্টানের গৃহপালিত শুকর হত্যা করেছিল বলে সেই দলেরই সবাই ওদের তিরষ্কার করে। ওদের কথা হচ্ছে বিনা অনুমতিতে অন্যের সম্পদ থেকে একটি আঙ্গুর পেড়ে খাওয়াও গুনাহ, এবং অন্যের গৃহপালিত জানোয়ার হত্যাতো আরও বড় গুনাহ! তারা বাগান এবং শূকরের মালিককে ডেকে ক্ষমা চায়, এবং ক্ষতিপূরনও দেয়। ওদের এই কাজ দেখলে যে কেউ ভাববে তারা বিরাট ধার্মিক! কিন্তু মাত্রই যে তারা সাহাবী হত্যা করে এসেছে, সেটাকে কী বলবি? তাদের ফলোয়াররা কিন্তু সেটাকেও জাস্টিফায়েড মনে করে।"

"তুই কী বলতে চাস?"
"আমি বলতে চাই, কোন কিছুতেই এক্সট্রিম হওয়া উচিৎ না। আমি তোকে নবীজির (সঃ) ভবিষ্যতবাণীর কথা বললাম, তোকে হযরত আলীর (রাঃ) জীবনের ঘটনাও বললাম। একটা জিনিস লক্ষ্য কর, না নবীজি (সঃ), আর না আলী(রাঃ) তাঁদের মতবিরোধ করায় কাউকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারা প্রথম হত্যাকান্ড ঘটালো? পথভ্রষ্টরা। যারা কট্টরপন্থী, ধর্মান্ধ। এতই অন্ধ যে সামনে নবীজি(সঃ), খলিফা, সাহাবী কাউকেই দেখতে পায়নি। ধর্মান্ধতার জন্য তারা আল্লাহরও বিপক্ষে যায় এবং সেটাও তারা দেখতে পায় না।"
সোহেল কিছু বলল না। বুঝা গেল সে কিছু একটা বুঝতে পারছে।

"ইসলামে কখনই বলা হয়না নিরপরাধ কারও রক্ত ঝরাতে। নবীজির (সঃ) স্পষ্ট হাদিস আছে, পিতার অপরাধে পুত্রকে, অথবা পুত্রের অপরাধে পিতাকে সাজা দেয়া যাবেনা। কোনভাবেই না। কিন্তু ইসলামের নামে রক্ত ঝরানেওলা সেই নবীজির (সঃ) যুগেও ছিল, এই যুগেও আছে। আফসোস যে ভবিষ্যতেও থাকবে। পুরনো উদাহরণগুলোতো দিলাম, বর্তমানের কিছু উদাহরণ দিব? জুহেইমানের গল্প শুনেছিস? ১৯৭৯ সালের বিশে নভেম্বর তারিখে সে কাবা শরীফ দখল করে ফেলেছিল। কাবাগৃহে অবস্থানকারী মানুষদের সে এক সপ্তাহের মতন জিম্মি করে রেখেছিল। মেশিনগান চালিয়ে খোদ কাবা শরীফে সে নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত ঘটায়। কেন? তার ধারনা ছিল সে কাবা ঘর দখলের মাধ্যমে ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্ব নিবে। বিপথগামী মুসলমানদের সে আল্লাহর রাস্তায় পরিচালিত করবে। এই হচ্ছে তার 'শান্তির' পথ। সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরানো! তুই ইচ্ছা করলে গুগল করে আরও বিস্তারিত জেনে নিতে পারিস।"
"তুই এদের সাথে ফিলিস্তিনি, ইরাকি, আফগানি মুজাহিদদের তুলনা করছিস কিভাবে?"

"এতে কোনই সন্দেহ নাই যে কারও দেশ আক্রান্ত হলে সেই দেশ রক্ষার জন্য জিহাদ করা ফরয। কিন্তু তার মানে এই না তুই গিয়ে অন্য দেশের সাধারণ মানুষ হত্যা করবি। অ্যামেরিকান মিলিটারী কি করলো না করলো, তারজন্য টুইন টাওয়ারের হাজারো নিরপরাধ মানুষ মারার পেছনে যুক্তি কী? শুধু মানুষ মেরেইতো ঘটনার শেষ হয়নি, কোটি মানুষের অর্থনৈতিক জীবনেও তার প্রভাব পড়েছে - সবাই নিরপরাধ ছিলেন। মার্কিন আগ্রাসী নীতির সাথে যাদের কোনই সম্পর্ক নেই। বোমা ফেটেছে বালিতে, বোমা ফেটেছে লন্ডনে, বোমা ফেটেছে বোস্টনে। নিহত মানুষদের একশো ভাগই নিরপরাধ। এইটাই কী ইসলাম? কোথায় বলা হয়েছে এইটাকে 'জিহাদ' বলে?"

"আর তাদের সরকার যে নিরপরাধ আফগানদের হত্যা করলো? ইরাকে হামলা চালালো? সেসব চোখে পড়ে না?"
"ওদের ছুতোটা কারা দিয়েছে? ওরা কী ভেবেছিল, টুইন টাওয়ার ধ্বসিয়ে দিলে অ্যামেরিকা চুপচাপ বসে থাকবে? সম্ভাব্য মার্কিন হামলা থেকে বাঁচার জন্য তাদের কোন ব্যবস্থা ছিল? ইসলাম এমন বেকুবের মত কাজ কখনও করতে বলে? আহাম্মকেরা ‘হুদায়বিয়ার সন্ধির’ ঘটনা থেকে কিছুই শিখে না। তোর ‘জিহাদী ভাইয়েরা’ কেবল মানুষ মারা পর্যন্তই চিন্তা করে। এর কনসিকোয়েন্স চিন্তা করতে পারেনা। এদের সব ধ্যান জ্ঞানই কেবল অন্যের ক্ষতি সাধন! নিজের ক্ষতির পরিমান যে কয়েকগুণ বেশি হবে, সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই! আফগানিস্তানে সাধারণ মানুষ হত্যার জন্য অ্যামেরিকা যেমন দায়ী, তোর so called 'জিহাদী' ভাইয়েরাও সমান দায়ী!"
"অ্যামেরিকা যে ইরাকে যুদ্ধ ঘটালো? লিবিয়ায় সন্ত্রাস? পৃথিবীর সব মুসলমান দেশের বিরুদ্ধেই তোর দেশ লাগছে, আর দোষ কেবল মুসলমানদের?"

"ইরাকে যে যুদ্ধ হয়েছে, সেটা কোন ধর্মযুদ্ধ ছিল না। সবাই জানে যে তেলের জন্যই সেই আক্রমণ হয়েছিল। মিডল ইস্টেও অশান্তির পেছনে মূল কারন তেল। সেটা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু তারা জিসাসের নাম নিয়ে মানুষ মেরে আসেনি। এখন ইরাকে যা ঘটছে, তোদের আই.এস ভাইয়েরা যা চালাচ্ছে, সুন্নি মুসলিম ছাড়া বাকি সবাইকে জবাই করে ফেলছে, সেটা এক কথায় নবীজির (সঃ) সেই অভিশপ্ত সম্প্রদায়ের আধুনিক সংস্করণ, যারা স্রেফ হত্যা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারেনা। মাথামোটা এইসব মৌলবাদীরা মনে করে তাদের সাথে থাকলেই কেউ বেহেস্তে যাবে, নাহলে খুন করার অধিকার তাদের আছে। কেনরে ইবলিসের চ্যালারা, মানুষকে বেহেস্তে নেয়ার দায়িত্ব কি আল্লাহ শুধুই তোদের হাতে দিয়েছেন? সেটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলে সমস্যা কোথায়? মানুষ খুনের মাধ্যমে এরা শান্তি আনতে চায়! এরচেয়ে হাস্যকর যুক্তি আর কী হতে পারে?"
"ওদের জায়গায় না গেলে তুই বুঝবি না।"
এবারে জাকিরের গলা চড়ে গেল।

"আর ওদের ভিকটিমদের জায়গায় কে যাবে? নিরীহ সাংবাদিকদের পশুর মত জবাই করে মারছে। যেখানে ইসলামে বলা হয়েছে বিনা কারনে একটি গাছ কাটাও নিষেধ, তারা সেখানে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মানুষ জবাইকে হালাল করার চেষ্টা করে? লাভটা কী হলো? যুদ্ধবিমুখ সাধারণ অ্যামেরিকানরা এখন একজোট হয়ে সরকারের কাছে দাবী করছে ইরাক আক্রমনের জন্য। বিশ্বব্যাপী ইসলামকে 'সন্ত্রাসী ধর্ম' হিসেবে বদনাম করার পেছনে কাদের অবদান সবচেয়ে বেশি? তোদের আলকায়েদা, আই.এস টাইপের জঙ্গি গোষ্ঠীদের। আমাদের দেশেও যে আজকে এত মানুষ ইসলাম বিমুখ, তোর কী ধারনা 'রগ কাটা' জামাত শিবিরের কোনই অবদান নেই তাতে?"
“তুই বেশিই কথা বলা শুরু করেছিস।"

জাকির জানে সোহেলের বুকে শেল বিধিয়ে দিয়েছে। সোহেল কট্টরপন্থী মুসলিম। কলেজ জীবনে ছাত্র শিবির করতো। জামাত যে একাত্তুরে রাজাকার ছিল, এই সহজ সত্য স্বীকারে সে বিমুখ।

জাকির গলার দৃঢ়তা বিন্দুমাত্র না কমিয়ে বলতে লাগলো, "দরকার আছে বলেই বেশি কথা বলছি। তোদের এই এক সমস্যা, দাড়িওয়ালা কেউ কিছু বললেই লাফায় লাফায় বিশ্বাস করিস। একটুও যাচাই বাছাই করার চেষ্টা করিস না। তোদের মতের বিরোধী হলেই তোরা শুনতে চাস না। এমনকি বিরুদ্ধমতের কাউকে হত্যা করতেও পিছপা হোস না। তোকে যে দুইটা ঘটনা শুনালাম, তুইই বল, তোরা কাদের ফলো করছিস?"

"অ্যামেরিকায় থেকে থেকে তোরও মাথা গেছে। তুই বেশি পন্ডিত মনে করা শুরু করেছিস নিজেকে। ইসলাম নিয়ে তোর কোন পড়াশোনা আছে? মাদ্রাসায় গিয়েছিস কখনও? কয়টা আলেমের লেখা বই তুই পড়েছিস?"
"অ্যামেরিকায় আসায় আমার এই সুবিধা হয়েছে যে আমি অনেক অনেক বড় বড় ইসলামিক স্কলারদের লেকচার নিয়মিত শুনতে পেরেছি। নিজের ধর্ম নিয়ে আমার অনেক ভ্রান্ত ধারনা দূর হয়েছে। তোদের জন্য আফসোস হয়, তোদের ‘আলেম পীরেরা’ তোদের যাই বুঝায়, তোরাও তাই বিশ্বাস করিস।"

সোহেল তাচ্ছিল্য করে বলল, "তোদের লেকচারাররা কী? কোট-প্যান্ট পড়ে থাকে। খৃষ্টানদের পোশাক! ইসলামী পোশাকে কয়জনকে দেখা যায়?""

জাকির হেসে বলল, "এইযে তুই তোর জ্ঞানের দৌড় দেখিয়ে দিলি। আরে, পুরুষদের জন্য 'ইসলামী পোশাক' বলে পৃথিবীতে আলাদা কিছু আছে নাকি? নবীজি (সঃ) যে পোশাক পড়তেন, আবু জাহেলও সেই একই পোশাক পড়তো। সেটা ছিল আরবের সাধারন পোশাক। ইসলাম বলেছে, শরীর ঢেকে রাখতে, ব্যস। 'জোব্বা' পড়লে বেশি সওয়াব হবে, আর কোট প্যান্ট পড়লে গুনাহ - এইসব তোদের স্বল্পবিদ্যার মোল্লাদের ফতোয়া। তোদের সমস্যা হচ্ছে, তোরা সবসময়েই অতি Radical হয়ে যাস। নাশকতা করতে করতে তোরা প্রাণ দিতেও পিছপা হোস না। আফসোস! তোদের এই প্রাণত্যাগ মিথ্যা কারনে ঘটে। নবীজি (সঃ) সাবধান করে বলেছিলেন, 'ওদের ধর্মাচরণ দেখলে মনে হবে ওরা তোমাদের চেয়ে বেশি ধার্মিক, বরং তোমাদের ধর্মাচরণ তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ হবে।' ওদের দেখে বিভ্রান্ত না হবার পরামর্শ খোদ নবীজিই (সঃ) দিয়েছেন।"
সোহেল কথা খুঁজে পায়না।

জাকিরকে টেলিফোন অপারেটর ওয়ার্নিং দেয়। তার কার্ডের টাকা শেষ হয়ে আসছে। মাত্র এক মিনিট বাকি আছে।
সে গলা নরম করে বলে, "শোন বন্ধু, ধর্ম অত্যন্ত সেনসিটিভ এবং ব্যক্তিগত একটি বিষয়। একে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে আল্লাহ এবং নবীজিই (সঃ) নিষেধ করে দিয়েছেন। সুরাহ ক্বাফিরুন এবং বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ আবার পড়। শুধু শুধু মনে হিংসা পুষে কী লাভ? উগ্রপন্থী মুসলিম, নন-প্র্যাকটিসিং মুসলিম, স্বল্পজ্ঞানী ফতোয়াবাজ এরা সবাইই ইসলামের জন্য চরম ক্ষতিকারক।"

"তারমানে ফিলিস্তিনের গণহত্যার কোনই প্রতিবাদ করবো না? ইরাকে চলমান ড্রোন হামলার আমরা কিছুই করবো না?"

"তুই আমাকে বল, তুই কিছু করতে পারবি? প্লেনে করে ফিলিস্তিনে গিয়ে যুদ্ধ করা তোর পক্ষে সম্ভব? কিন্তু তাই বলে তুই যদি রাস্তা থেকে একজন random সাদা চামড়ার অ্যামেরিকান ধরে জবাই করে দিস, সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? তুই নিন্দা জানা। ইন্টারনেটে নিন্দা জানা, rally করে নিন্দা জানা, লেখালেখি করে নিন্দা জানা। ইসলামে স্পষ্ট বলা আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোও জিহাদ। টাকা পয়সা দিয়ে আহত-নিহত মানুষদের সাহায্য কর। তোর পক্ষে যেসব সম্ভব এবং লজিক্যাল সেসব তুই কর। ভুলে যাস কিভাবে যে ইসলাম একটি লজিক্যাল ধর্ম, মোটেও ইমোশনাল ধর্ম নয়।"

সোহেলের কথা শোনা গেল না। কলিং কার্ডের ক্রেডিট শেষ হয়ে যাওয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
জাকির নিজের ডেস্কে ফিরে এলো। সোহেলকে অনলাইনে পাওয়া গেল।
একটা দীর্ঘ ইসলামী লেকচার দিয়ে জাকির মোটামুটি উৎফুল্ল।

সোহেল বলল, "বন্ধু, তোর কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিৎ।"
জাকির বলল, "পড়াশোনা কর। বুদ্ধি খাটা, যুক্তির ব্যবহার কর। ইসলামে অযৌক্তিক কিছুই নেই। তোর মনে কোন প্রশ্ন জাগলে স্কলার কাউকে খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করে উত্তর জেনে নে। ইন্টারনেটের যুগে এখন এসব খুবই সহজ ব্যপার।"
সোহেল বলল, "তুই বুঝতে পারছিস না। তুই যদি ঠিক হয়ে থাকিস, তোর কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের ধ্বংস হতে খুব বেশি বাকি নেই। উগ্রবাদ, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা এখন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। বেশিরভাগই ভুলভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করছে। আমরা আল্লাহর নামে নিরপরাধ মানুষ খুন করতেও দুইবার চিন্তা করিনা। আমাদের বলা হয়, এসব নাকি জিহাদের অংশ। বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণও দেয়া হয়।"
জাকির চ্যাটেই হেসে দিল।

"হাহাহা। বন্ধু, শয়তানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কি জানো? সেও কিন্তু সত্য বলে, তবে আংশিক সত্য। সেটা মিথ্যার চেয়েও খারাপ। মানুষ বছরের পর ধরে পড়াশোনা করে স্কলার হয়। ওরা দুই চারটা বই পড়েই নিজেদের বিরাট পন্ডিত ভেবে বসে থাকে! আরে, ওদের কথা বিশ্বাস করার আগে তোর নিজের মনকে জিজ্ঞেস করবি ‘শান্তির ধর্ম’ ইসলামের সাথে সেটা কতটা যৌক্তিক। তারপরে কোন ইন্টারন্যাশনালি রেপুটেড স্কলারের সাথে আলোচনা করবি।"
সোহেল লিখলো, "হুমমম।"

জাকির বলল, "তোদের নিয়ত পরিষ্কার, এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। শুধু এতদিন বিপথে চালিত হয়েছিস। তোরা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাস, পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করতে চাস। এরচেয়ে মহৎ কোন কাজ দুনিয়ায় হতে পারেনা। তবে একটা কথা কী, বিধর্মীদের মুসলিম বানাবার আগে আমার মনে হয় আমাদের মুসলমানদের 'মুসলিম' হওয়াটা ভীষণ জরুরী।"
সোহেল বলল, "কাজটা সহজ হবেনা।"

"নবীজি (সঃ) যদি জাহেলি যুগে ইসলাম প্রচার শুরু করতে পারেন, তাহলে তুই কেন মুসলমানদেরই সুপথে আনতে পারবি না? চেষ্টা কর, এই রাস্তায় তোর সাথে আরও অনেককেই পাবি। হয়তো একঝাক মানুষ তোর কথা শুনবে না। হয়তো এক দুইজন সঠিক রাস্তায় ফিরবে। কিন্তু ভুলে যাসনে, অসীমের গণনার শুরুটা এই ‘এক, দুই’ থেকেই হয়।"
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/

**** তথ্য ও গল্পের সাবজেক্ট সরবরাহ, বাল্য সুহৃদ সৈয়দ সাজিদ মাহমুদ (sad but true পেজের অ্যাডমিন)

No comments:

Post a Comment