Labels: ,

কাফিরের সাথে মিশলে গুনাহ

এক সিনিয়র আপু একদিন আমাকে ডালাস নিবাসী এক ভদ্রলোকের গল্প বলেছিলেন, যিনি নাকি কোন "কাফিরের" সাথে ছোয়াছুয়ি হয়ে গেলে বাড়িতে গিয়ে গোসল করে পাক সাফ হয়ে আল্লাহর দরবারে তওবা করেন। যিনি অতি গর্বের সাথে বলে বেড়ান তাঁর কোন কাফির বন্ধু নেই। তাঁর ছেলে মেয়েরাও কোন বিধর্মীর সাথে মেলামেশা করেনা।
বেচারার ঘটনা শুনে আমার অতি প্রাচীন একটি বাংলা প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেল - খালি কলসি বাজে বেশি। ভদ্র বাংলায় বললে অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। ইংরেজিতেও আক্ষরিক প্রবাদ আছে, Little knowledge is a dangerous thing. যেহেতু ইংরেজিতেও প্রবাদটির প্রচলন আছে, তারমানে এটি সকল জাতির সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। শুধুমাত্র বাঙালিরাই এককভাবে এই দোষে দুষ্ট নয়।
এখন মূল কথায় আসা যাক।

আমাদের মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ধর্মীয় ব্যপারে আমরা খুব গোড়া। এটা করলে জাহান্নামে যেতে হবে, ওটা করলে জাহান্নামে যেতে হবে - সেটাতো করাই যাবেনা। যে যত কঠিন ফতোয়া জারি করবে, আমরা চোখ বন্ধ করে কিছু যাচাই বাছাই না করেই মেনে নিব। "জান্নাতে যেতে হবে, রাস্তা এত সহজ হলে চলে?"
কাজেই কাফিরদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দাও। ওদের হাতের খাবার খাওয়াতো দুরের কথা, ওদের হাতের স্পর্শও এড়িয়ে চলো। ওরা বাঁচুক কী মরুক আমার কী? আমি আমার আল্লাহর ইবাদত করে যাব। কারণ তিনিতো আমাকে তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। কুরআন শরীফে স্পষ্ট লেখা আছে যে!

লোকটাকে কে বুঝাবে যে একটা লোকের সাথে হাসিমুখে কথা বলাটাও আল্লাহর ইবাদত। একটা অসহায়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়াটাও আল্লাহর ইবাদত। আল্লাহর যদি কেবল নিজের নামের জিকির আসগরের জন্যই সৃষ্টি করতে হতো, তাহলে মানুষকে সৃষ্টি করতেন না - সেজন্য ফেরেস্তা ছিলই। মানুষের সৃষ্টি হয়েছে আরও কল্যানের জন্য, এর পেছনে আরও মহৎ উদ্দেশ্য জড়িত। সুরাহ ইয়াসিনের সেই লোকটার মতন আফসোস করে বলতে হয়, "আমার লোকেরা যদি বুঝতে পারতো!"

এখন নিজের যুক্তির পেছনের প্রমানে আসা যাক। এবং বরাবরের মতই আমি আমার নবীর(সঃ) জীবনী থেকে উদাহরণ দিব। কারও কোন সন্দেহ থাকলে সে যেন ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে গবেষণা করে নেয়। এই বাহানায় অন্তত কেউতো তাঁর জীবনী পড়বেন! আফসোস! তাঁর জীবনী যেখানে আমাদের inside out, upside down মুখস্ত থাকার কথা ছিল - সেখানে আমরা বলতে গেলে কিছুই জানিনা। তাঁর জীবনী ঠিক মতন জানা থাকলে পৃথিবীতে কোনই সমস্যা থাকত না। সবাই বুঝতো, চৌদ্দশ বছর আগের ঘটনাও কিভাবে বর্তমান জীবনের সাথেও যোগসূত্র স্থাপন করে!
মুতইম ইবনে আদির নাম কয়জন জানেন? বনু নওফল গোত্রের একজন শক্তিশালী নেতা ছিলেন এই ব্যক্তি। মক্কার দুর্ধর্ষ কুরাইশ নেতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও যিনি ন্যায়ের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেন। এবং অবশ্যই এই লোকটি জীবিতাবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেননি। এখন যদি বলি এই লোকটির কাছে আমাদের নবীজি এবং ইসলাম ধর্মই ঋণী হয়ে আছে, বিশ্বাস করবেন?

ভদ্রলোকের অনেক ঘটনা আছে, তবে দুইটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।
নবীজির জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম তিনটি বছরের ঘটনা কে কে জানেন? যখন তাঁকে ও তাঁর সাথীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হলো, কেউ তাঁদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না, কোন লেনদেন করবে না - তাঁরা মরুক কী বাঁচুক, কেউ তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেনা, মুসলিমরা মক্কার বাইরে একটি উপত্যকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে, উপত্যকাটি ছিল আবু তালিবের, আমাদের নবীজির (সঃ) চাচা এবং একজন "কাফির।" যিনি নিজেও বৃদ্ধ বয়সে সমাজচ্যুত এই মুসলিমদের সাথে বেরিয়ে এসেছিলেন। মুশরিক ও কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নেতা হবার পরেও। "কাফির" হবার পরেও।

যাই হোক, সামাজিক বয়কটের ঐ তীব্র সময়টা কতটা ভয়ংকর ছিল সেটা বর্ণনা করা অসম্ভব। খাবার নেই, পানি নেই, সাহাবীরা বলেছিলেন "আমরা আমাদের পশুর চামড়া সিদ্ধ করে খেয়েছি। গাছের পাতা চিবিয়ে খেয়েছি। আমরাও জানিনা আমরা কিভাবে তখন বেঁচেছি।"

তিনটা বছর এই অমানবিক কষ্টের মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হয়েছিল। তাঁরা মারাই যেতেন, কিন্তু একজনের জন্য সেটা ঘটেনি। তিনি হচ্ছেন এই মুতইম ইবনে আদি। তিনি প্রতি এক দুইমাসে একটি উট বোঝাই খাবার দাবার দিয়ে তাঁদের উপত্যকায় ছেড়ে আসতেন। সেই উটের মাংস ও রুটি খেয়ে আমাদের নবীজি (সঃ) ও তাঁর সাহাবীরা বেঁচে ছিলেন। নাহলে "ইসলাম" সেই মক্কার পাশের সেই উপত্যকাতেই দাফন হয়ে যেত। আমাদের কী সেই কাফিরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ না?
আর ওরা বলে "কাফিরদের হাতে কিছু খাওয়া হারাম!"

আবু তালিবের মৃত্যুর পর আবু লাহাব যখন নেতা হলো, সে নবীজির (সঃ) উপর থেকে protection উঠিয়ে নিল। আধুনিক ভাষায় বলতে গেলে সিটিজেনশিপ revoke করলো। নবীজীর (সঃ) আর কোন আশ্রয় থাকলো না। তিনি মক্কা থেকে তায়েফে চলে যাবার চেষ্টা করলেন। সেখানে কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি। এবং তায়েফ থেকে আহতাবস্থায় ফিরে আসার পর মক্কায় তাঁর থাকার কোন উপায় ছিল না। এই সময়ে মুতইম ইবনে আদি তাঁর ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিলেন, "আমি এবং আমার ছেলেরা বেঁচে থাকতে খবরদার কেউ মুহাম্মদের (সঃ) এতটুকু ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করো না।"

আবু সুফিয়ান তখনও কুরাইশ নেতা, গলা উঁচিয়ে বললেন, "তুমিও কী মুসলিম হয়ে গেলে?"
"না।"
"তাহলে ঠিক আছে। আমরা আপাতত মুহাম্মদকে (সঃ) কিছু করবো না।"
এবং তারপরেও আমরা জানি কিভাবে ওরা সবাই মিলে এক রাতে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েছিল। এবং তিনি সেই রাতেই মদিনায় পালিয়ে যান।
মদিনায় পালানোর ব্যপারেও একটা উদাহরণ আছে। হত্যায় ব্যর্থ কুরাইশরা রাগে উন্মাদ হয়ে ঘোষণা দিল, "যে মুহাম্মদের (সঃ) মৃতদেহ আমাদের সামনে হাজির করবে, তাকে একশ উট পুরস্কার দেয়া হবে।"

তখনকার যুগের একশ উট মানে এখনকার যুগে মিলিয়ন ডলার। টাকার লোভ ভয়ংকর লোভ। ছেলে নিজের আপন পিতার সাথেও পয়সার লোভে বেইমানি করে বসে। তাই তখন চারিদিকে নবীজির(সঃ) শত্রু। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি মদিনা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাইড হিসেবে কাকে বেছে নিলেন? একজন কাফিরকে। যে লোকটা এত এত টাকার লোভ সামলেও নবীজি(সঃ) ও তাঁর সঙ্গী হজরত আবু বকরকে (রাঃ) নিরাপদে মদিনায় পৌছে দিয়েছিলেন।
এবং তারপরেও একদল আহাম্মক দাবি করে কাফিরদের সাথে মেলামেশা হারাম। ওদের স্পর্শ পেলে তওবা করতে হয়। ম্যা ম্যা ম্যা।

এই সমস্ত লোকেরা সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলে তখন কাফির-মুসলিম নিয়ে তর্ক করার পরে শুরু করে শিয়া-সুন্নি বিতর্ক। তারপর হানাফি-শাফিই। তারপর বাঙালি-অবাঙালি। মোট কথা এই সমস্ত কুলাঙ্গারগুলিই সমাজে বিভেদ তৈরির জন্য দায়ী। এদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন, গ্যারান্টি দিচ্ছি, সমাজে কোন অশান্তি থাকবে না।
"অমুকের কাজ শরীয়ত মোতাবেক নয়।"
"তমুকের কাজ ইসলাম বিরোধী।"
"অমুকতো জাহান্নামী! ওর নাম মুখে আনাও পাপ।"

কথা হচ্ছে, সবার বোঝা উচিৎ যে আমরা সবাই একটি অতি বৃহৎ পরিকল্পনার অতি ক্ষুদ্রতম অংশ। কে মুসলিম হবে, কে কাফির থাকবে, কে আবু জাহেল হবে, কে মুতইম ইবনে আদি হবে এবং কে হবে আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) - এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আল্লাহ আমাদের উপর ছাড়েন নাই। উল্টা তাঁর পরিকল্পনায় ফালতু মন্তব্য করা তাঁকেই অপমান করার সামিল। আদম সৃষ্টির বহু আগেই ইবলিশকে সৃষ্টি করা হয়েছিল - কেন কখনও কী ভেবে দেখেছে?
এক বিখ্যাত অভিনেতাকে চিনতাম যিনি গোপনে দুইটা এতিম খানায় প্রচুর দান খয়রাত করতেন। এতিম শিশুগুলি বেঁচে ছিল মূলত তাঁর দেয়া পয়সায়।

লোকটা মারা যাওয়ার পর অনেককেই বলতে শুনেছি তিনি নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে যাচ্ছেন। কিন্তু একজনকেও দেখিনি এগিয়ে এসে বলতে যে "আমিই সেই এতিমখানাগুলোর দায়িত্ব নিলাম।"
এতিম শিশুগুলির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, কে তাঁদের কাছে হিরো? "লোকটা জাহান্নামী" - ফতোয়া দেয়া মাওলানা, নাকি সেই জাহান্নামী ব্যক্তিটা?

আমাদের নবীজি (সঃ) স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন গরিবদের প্রতি সদয় হতে, এতিমদের দেখভাল করতে। আমার মনে পড়েনা আমি কোথাও পড়েছি তিনি মুসলিম এতিমকে বেশি আদর করেছেন এবং মুশরিক এতিমকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমরা বারবার ভুলে যাই, রাসুলুল্লাহ হবারও বহু আগে থেকে তিনি আল-আমিন ছিলেন। মক্কা ছেড়ে যাবার সময়েও তাঁর কাছে গচ্ছিত আমানত যেন সবাই ফেরত পান, সেকারনে নিজের প্রিয় সহচর ছোট্ট আলীকে (রাঃ) জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও রেখে গিয়েছিলেন। কাদের আমানত ছিল সেসব? তাঁরই জীবন নিতে চাওয়া কাফির মুশরিকদের।
আমরা নিজেদের আমাদের নবীর(সঃ) চেয়েও বেশি পন্ডিত মনে করি। সমস্যাটা এখানেই।
খালিদ বিন ওয়ালিদ মৃত্যুশয্যায় বলে গিয়েছিলেন, "আমি সারাজীবন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকায় কুরআন শিক্ষা নিতে পারিনি। তবে আমার আফসোস নেই, আমি অন্যভাবে আল্লাহর কাজে এসেছি।"

খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাণী। কে কিভাবে আল্লাহর কাজে আসছে সেটা বুঝার ক্ষমতা আপনাকে আমাকে দেয়া হয়নি। কাজেই ফালতু মন্তব্য করার আগে কয়েকবার ভেবে চিন্তে নিবেন।

যে ভদ্রলোক গর্ব করে বলেন তার এলাকায় কোন বিধর্মী প্রতিবেশী নেই, তাঁকে শুধু জানিয়ে দিতে চাই যে আমাদের নবীজিরও (সঃ) ইহুদি প্রতিবেশী ছিল, এবং সেই নবীই "প্রতিবেশীর অধিকার" শিরোনামে অনেকগুলো নির্দেশ দিয়ে গেছেন, যা পালন করা অবশ্য কর্তব্য।

দ্বীনের দাওয়াত দিতে বস্তিতে যাচ্ছেন খুবই ভাল কথা। কিন্তু যখন তাঁদের শিশুরা না খেয়ে ঘুমাতে যায় এবং অসহায় মা বাবা নিরবে অশ্রু ফেলেন তখনও অন্তত এক মুঠ চাল আর সাথে কিছু সবজি নিয়ে হলেও আপনার সেখানে গিয়ে বলা উচিৎ, "নবীর নির্দেশ পালন করতে এসেছি। ছেলে মেয়েদের উঠাও, একসাথে মিলে চারটা ভাত খাই।"
বিশ্বাস করেন, আপনি শুধু আপনার আচরণ দিয়েই পৃথিবী পাল্টে দিতে পারবেন। কোন বন্দুক, তলোয়ার, বুলেটের প্রয়োজন হবেনা।

ঈদের দিনে আপনার পাড়ার হতদরিদ্র বিধর্মী পরিবারকে নিজের বাড়িতে এনে নিজের সেরা আসনে বসিয়ে জর্দা-সেমাই খাওয়ান। ওরাও জানুক আমরা কেমন নেতার ফলোয়ার। আর তাছাড়া মুতইম ইবনে আদির মতন লোকেদের কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে আছি, এতে যদি কিছুটা ঋণ শোধ হয়!

পোস্টটি  লিখেছেন: মঞ্জুর চৌধুরী 

No comments:

Post a Comment