Labels: , , ,

আজকে "ব্লগার" একটি গালি! ধার্মিক মানেই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী! মুক্তমনা মানেই ভন্ড।

বাংলাদেশী অনলাইন জগতে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হচ্ছে "মুক্তমনা।" একদল লোক শব্দটিকে গালি বানিয়ে দিয়েছে। তাদের কাছে মুক্তমনা মানেই কাফের, নাস্তিক, এদের ফাঁসি চাই। আরেকদল নিজেদের মুক্তমনা দাবি করে নিজেদের মনের পারভার্টনেস, গালাগালি, মস্তিষ্কের পায়খানা ইত্যাদি বের করে এনে অনলাইন জগৎকে দূষিত করছে। আজকে হঠাৎ করেই মনে হলো, এ নিয়েই কিছু কথা বলে ফেলি।
তাহলে একটু ঘুর পথেই মূল বিষয়ে যাওয়া যাক।

মত প্রকাশের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। মায়ের পেট থেকে সে স্বাধীন হয়েই বের হয়। তাঁকে কেউ পরাধীন বানালে সেটা মানুষ বানায়, প্রকৃতি নয়। জন্মের পর থেকেই নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে বড় হতে থাকে। তাঁর মস্তিষ্কের ব্ল্যাংক হার্ডডিস্কে ধীরে ধীরে নানা তথ্য জমা হতে থাকে। এবং অতি স্বাভাবিক কারনেই তাঁর মনে নানান বিষয়ে নানান সময়ে নানান প্রশ্ন জেগে উঠে। কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর একান্ত নিজস্ব মত সৃষ্টি হতে থাকে। এবং এই প্রশ্ন করার অধিকার, এবং কোন বিষয়ে মত প্রকাশের অধিকারটাই তাঁর জন্মগত অধিকার। আমাদের কাউকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি সেই অধিকার দাবিয়ে রাখার।

এখন সেই মত প্রকাশের বা প্রশ্ন করার মাঝে একটা শালীনতা, একটা পরিমিতি বোধ থাকা প্রতিটা মানুষেরই উচিৎ। আমার হাতে রাইফেল ধরিয়ে দিলেই আমি গুলি করে যাকে তাকে মেরে ফেলতে পারিনা। এইটুকু বিবেক বোধ আমার থাকাটা জরুরী।যখনই কেউ সীমা অতিক্রম করে, তখন সেটা আর মুক্তমন থাকেনা, ফাজলামি হয়ে যায়। এখন আমাদের দেশে ঠিক যেটা চলছে।
ব্যাখ্যা করলে কিছুটা স্পষ্ট হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যৌবনে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁর "ব্লগের" উপসংহারে লিখেন, "ইহা আসলে কোন মহাকাব্যই নয়।"এখন মাইকেলের ভক্তেরা যদি রবীন্দ্রনাথের উপর ক্ষেপে গিয়ে ব্লগিং শুরু করে দেন যে "এই শালা বউদির সাথে প্রেম করে, যেখানে সেখানে প্রেম করে, লুইচ্চা ব্যাটা মহাকাব্যের কী বুঝে?" এবং অফ টপিক সমালোচনা, ব্যক্তিগত আক্রমন। সেটা আর মত প্রকাশ থাকেনা, মুক্তমনেরতো ধারে কাছেও যায় না। এইটাই ফাজলামি। আসল মুক্তমনারা রবীন্দ্রনাথের সাথে সুস্থ আলোচনায় বসবে, এবং যদি আলোচনা ফলপ্রসু না হয় তাহলে যে যার বিশ্বাস নিয়ে স্থির থাকবে। তবু ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করবে না।
কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলি, শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যৌবনে তিনি কী ভুলটাই না করেছিলেন। তিনি তাই নিজের সমালোচনা করে বলেছিলেন, মেঘনাদবধ কাব্যের মাহাত্য বুঝার মত বয়স তখন তাঁর ছিল না।
এমনি এমনি কেউ "কবিগুরু" হয়না। বিশাল একটা কলিজা থাকা লাগে।
এখন সরাসরি পয়েন্টে আসি।

আজকাল মুক্তমনার ছদ্মবেশে মানুষ ধর্মকে সরাসরি আক্রমন করছে। ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখালেখি এক বিষয়, আর ফাজলামি ভিন্ন। দেশে এখন ফাজলামি চলছে বেশি। যেমন, কেউ যদি হিন্দু ধর্মের গোড়ামির সমালোচনা করতে চায়, সে বর্ণ প্রথা নিয়ে সমালোচনা করুক। "বিধবা নারীর বিবাহ শাস্ত্র সিদ্ধ নয়," "সতিদাহ প্রথা মহাপুন্যের," "ব্রাক্ষণের সঙ্গে যৌন মিলনে পাপ নেই" - ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলুক। এবং তারচেয়ে বড় কথা, নিজে সেটা পালন করুক।
কিন্তু কৃষ্ণ, রাম, শিবদের নামে খিস্তি গাওয়ার কী মানে?এর মানে একটাই, তাদের মূল উদ্দেশ্য সমাজ সংস্কার নয়, তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য উস্কানি।ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগর নিজের পুত্রের বিয়ে এক বিধবা নারীর সাথেই দিয়েছিলেন। যতদূর জানি, ঈশ্বর চন্দ্র কোন লেখায় কোন ধর্মকে আক্রমন করে কিছু লিখেননি।

তাই আমরা দেখতে পাই, "মুক্তমনার" দাবি তোলা এইসমস্ত ব্লগাররা কখনই সমাজ বদলের জন্য তেমন মুখ্য ভূমিকা রাখেননা। তারা অনলাইনে গালাগালি আর উস্কানি নিয়ে ব্যস্ত। সোমালিয়ায় একটি এতিম শিশুকে দেখভাল করতে মাসে মাত্র তিরিশ ডলার লাগে। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশে খরচ এর কাছাকাছিই হবে। কখনই দেখবেন না এইসব মুক্তমনাদের এইসব এতিম শিশুদের দেখভাল করতে।

আমি একবার এক মানবতাবাদী মুক্তমনাকে দেখেছিলাম রিক্সাওয়ালাকে ঠাস করে চড় মারতে। কারন সে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি চেয়েছিল। রিক্সাওয়ালার যুক্তি, সেদিন গরম বেশি ছিল।
মানুষের প্রতি মমতা এদের অনলাইন জগতেই সীমাবদ্ধ। আর পশুপাখির প্রতিতো নেই বললেই চলে।
এক সাইকোকে চিনতাম যে ক্ষধার্ত কুকুরের উপর গরম পানি ঢেলে দিয়ে খুব মজা পেত। চামড়া ঝলসে যাওয়ার যন্ত্রনায় কুকুরের চিত্কার শুনতে তার খুব ভাল লাগতো। সেই কিনা আবার নিজেকে মুক্তমনা দাবি করে মাঝে মাঝে স্ট্যাটাস দেয়।

তবে যারা আসলেই মানবতাবাদী, তাঁরা ফালতু খিস্তি আওরান না। তাঁদের মানসিকতাই ভিন্ন। এরাই অ্যাগনস্তিক, মানে হচ্ছে লজিক্যাল এবং তারচেয়েও ভদ্র, নাস্তিক। মোটেও ফাজিল নয়। আমার বন্ধু তালিকায় এদের সংখ্যা প্রচুর।
আর এইদিকে সেসব উস্কানিমূলক লেখা পড়ে মুমিন মুসলমানের রক্ত টগবগিয়ে ফুটে। তারা ঝাপিয়ে পড়ে মানুষ খুনের কাজে। এমন ভাব যেন ইসলাম বিপন্ন, এরা না মরলে ইসলামের সম্মান ধুলায় লুটাবে। নারায়ে তাকবির! আল্লাহু আকবার!

আহারে মুসলিম! আল্লাহর উপর এই তোদের ভরসা! এই তোদের রাসুলের নির্দেশ মেনে চলা?
এর ফলে পরিচিতি পাচ্ছে ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম। মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী!
এদের কিছু বুঝাতে যাবেন, আপনি হবেন কাফির। আপনিও হবেন নাস্তিক।
একদিকে তথাকথিত মুক্তমনা, অন্যদিকে এইসমস্ত মূর্খ মৌলবাদী - আমাদের অবস্থা পিষ্ট হওয়া মরিচের থেকেও দফারফা।
এইবার আসা যাক আসল পয়েন্টে।

বিরাট সংখ্যক মুসলমানদের একটা বিশ্বাস আছে যে আমাদের ধর্মকে কোন রকম প্রশ্ন করা যাবেনা। যা আছে, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে হবে। কারন ঈমানের আভিধানিক অর্থই বিশ্বাস। এবং ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমপর্ন। নবীজি (সঃ) যা বলেছেন, আল্লাহ যা বলেছেন, চোখ বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করে ফেলার নামই ঈমান।
কিন্তু কিউরিয়াস মন মাঝে মাঝেই জানতে চায়। এটা কেন হলো? ওটা কেন হলো? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রশ্ন করার অধিকার কী ইসলাম আমাকে দিচ্ছে? উত্তর হচ্ছে, আপনার পাড়ার মোল্লা হয়তো নাও দিতে পারেন, ইসলাম কিন্তু সেই অধিকার দিচ্ছে।
উদাহরণ দিচ্ছি।

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলের নাম কেউ কেউ হয়তো শুনেছেন। এই লোকটাকে বলা হতো মুনাফেক সর্দার। এক নম্বরের বিশ্বাসঘাতক। এই সেই শয়তান যে আরও অনেক অপকর্মের পাশাপাশি হজরত আয়েশার (রাঃ) নামে কুৎসা রটিয়েছিল। মানে নবীজির (সঃ) তার পারসনালপার্সোনাল শত্রুতা থাকার যথেষ্ট কারন ছিল।যেদিন সে মারা গেল, এবং সেটি ছিল ন্যাচারাল ডেথ, কোন কোপাকোপি নয়; নবীজি (সঃ) গেলেন তার জানাজায়। তিনি নিজে তার কবরে নেমে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। নিজের গায়ের কাপড় দিয়ে তার কাফন জড়ালেন। যদি কোন বাহানায় আল্লাহ এই মুনাফেককে মাফ করেন!

ছোট নোট, নবীজির এই ক্ষমার বৈশিষ্ট্য মুক্তমনা কিংবা মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের কারও নজরে পরবে না। এরা কাব বিন আশরাফ কাব বিন আশরাফ বলে লাফাতে থাকবে। বিরক্তিকর!  ছিদ্রান্বেষী না হয়ে যদি কেউ সত্যান্বেষী হতো, তাহলে অবশ্যই তাদের চোখে পড়তো।

তা যা বলছিলাম, নবীজির (সঃ) এহেন কর্মে অবাক হয়ে এক সাহাবী প্রশ্নই করে বসলেন, "হে আল্লাহর দূত! আল্লাহ কী আপনাকে নিষেধ করেননি এদের জন্য ক্ষমা চাইতে?"নবীজির কর্মকান্ডে প্রশ্ন করার সাহস কারোরই ছিল না। একজন বাদে। হজরত উমার(রাঃ)। যিনি ছিলেন "আল ফারুক" - সত্য মিথ্যার প্রভেদকারী। নবীজি (সঃ) তখন উত্তরে বললেন, "ইয়া উমার(রাঃ)। আল্লাহ আমাকে বলেছেন তুমি যদি সত্তুরবারও ওদের জন্য ক্ষমা চাও, তবুও আমি মাফ করবো না। তাই আমি একাত্তুরবার ক্ষমা চাইবো। যদি তিনি মাফ করেন!"
তাহলে এই ঘটনায় আমরা কী পাই? নবীজিকেও প্রশ্ন করা যায়। কেন এমন হচ্ছে? অমন কেন হচ্ছে না?
আরেকটা উদাহরণ লাগবে?

হুদায়বিয়ার সন্ধি। এখানেও প্রশ্নকর্তা সেই একই ব্যক্তি, উমার(রাঃ)।
"আপনি কী রাসূল নন? আমরা কী সৎপথে চালিত নই? ওরা কী জুলুমকারী নয়? তাহলে কেন সন্ধির এই অপমানজনক শর্তগুলো মেনে নিলেন? একে বিজয় বলছেন? কিভাবে?"
এক গাদা প্রশ্ন! বা সেই সাহাবিকেই বা আমরা কিভাবে ভুলে যাই যিনি নবীজিকে গিয়ে বলেছিলেন, "আমাকে ব্যাভিচারের অনুমতি দিন। আমি এবং মেয়েটি যদি পরস্পরের সম্মতিক্রমে ব্যভিচারে লিপ্ত হই, তাহলে কেন সেটি পাপ হবে?"কথা হচ্ছে, তিনি কী একবারও প্রশ্ন শুনে কাউকে কোপানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন?

এই গেল নবীজি। আপনারা কী জানেন আল্লাহকে পর্যন্ত প্রশ্ন করা যায়?
আদম সৃষ্টির ইচ্ছা প্রকাশ করলে ফেরেস্তাদের রিয়েকশন কী ছিল? "কেন আপনি ওদের সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন? ওরাতো পৃথিবীতে গিয়ে ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই করবেনা। আপনার ইবাদতের জন্য কী আমরাই যথেষ্ট নই?"
জ্বী, প্রশ্ন করার অধিকার ইসলামে আছে। তাই কেউ প্রশ্ন করলেই মারতে তেড়ে যাবেন না। নিজের সর্বোচ্চ বিদ্যা দিয়ে বুঝাবেন। না পারলে ক্ষমা চেয়ে নিবেন, এবং নিজেও সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা নিবেন। এতে আপনার নিজের জ্ঞান বাড়বে। কুপিয়ে দিলে জাহান্নামের খাতায় নিজের নামটা লেখানো ছাড়া আর কিছুই লাভ হবেনা।
এবং কে বলেছে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কখনও কিছু লেখা যাবেনা?

আপনি ইসলাম ধর্মে প্রচলিত নানান কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলুন, সমস্যা কী? আমি নিজে কী বলছি না? পীর ব্যবসা, পীর পূজা, কবর পূজা, মাজার ব্যবসা, ঝারফুক থেকে শুরু করে ধর্মের নামে কুপিয়ে মানুষ হত্যা - সবকিছুর বিরুদ্ধেইতো লিখছি। ইসলামী রেফারেন্স দিয়ে দিয়েই লিখছি। কেউ আসুক প্রমান নিয়ে, ভুল ধরিয়ে দিক। আমি তাহলে নিজের কথা ফিরিয়ে নিব। সেটা মুক্তমনা হোক, বা কাঠমোল্লা।

আমাদের বাঙালিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা আমাদের ভদ্রতার স্ট্যান্ডার্ড দিন দিন একদম পাতালে নামিয়ে আনছি। একটা সময়ে কেবল ভদ্রজনেরাই লেখালেখি করতেন। আফসোস! আজকে "ব্লগার" একটি গালি! আগে ধার্মিকদের দিকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে তাকাতো। আজকাল ধার্মিক মানেই মৌলবাদী, সন্ত্রাসী! 
Written by: মঞ্জুর চৌধুরী 

No comments:

Post a Comment