শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা' আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

মুহাম্মদ (সাঃ)-আল্লাহর রাসূল

মুহাম্মদ (সাঃ)-সকল মানুষের জন্য উদাহরন, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, ও আল্লাহর রাসুল

আল কোরআন - মহান আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব

এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,

আমাদেরকে সরল পথ দেখাও

আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

আল্লাহ নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু

সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

Labels: , ,

জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ইসলাম তথা পবিত্র আলকুরআন ও আল হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি

সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের কতিপয় দেশে জঙ্গিবাদ একটি বার্নিং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ইসলাম কখনো বোমাবাজি, হত্যা, গুপ্তহত্যা, আত্মঘাতী হামলাসহ কোন ধরনের অরাজকতা সমর্থন করে না। এই পথে যারা পা বাড়িয়েছে তারা জঘন্যতম অপরাধে জড়িত হয়েছে এবং ফিতনা-ফাসাদে লিপ্ত হয়েছে।
বক্ষমান প্রবন্ধে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ইসলাম তথা পবিত্র আলকুরআন ও আল হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। 

জঙ্গিবাদের সংজ্ঞা
জঙ্গি, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদী শব্দগুলোর মূল হল জঙ্গ। এটি (جنگ ـ ج ن گ) ফার্সী ও উর্দু ভাষার শব্দ। পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ একটি পত্রিকার নাম দৈনিক জঙ্গ। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, তুমুল কলহ, লড়াই, প্রচন্ড ঝগড়া। জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা। সেভাবে জঙ্গিবাদ অর্থ জঙ্গিদের মতবাদ, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ড। ইংরেজীতে বলা হয় Militant, Militancy কিংবা Military activities. Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে : Militant adj, Favouring the use of force or strong pressure to achieve one’s aim. অর্থাৎ কারো উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য শক্তি প্রয়োগ বা প্রবল চাপ প্রয়োগ। Chamber’s Twentieth Century Dictionary-তে বলা হয়েছে : Militant adj, fighting, engaged in warfare অর্থাৎ সংগ্রামরত বা যুদ্ধরত। আরেক জায়গায় বলা হয়েছে : using violence, অর্থাৎ সহিংসতা অবলম্বন করা। জঙ্গিবাদ যেহেতু নতুন শব্দ তাই এর আরবী প্রতিশব্দ আরবী অভিধানসমূহে পরিলক্ষিত হয় না। তবে এর কাছাকাছি যে শব্দটির ব্যবহার আমরা দেখতে পাই তা হল (الإرهاب) অর্থাৎ কাউকে ভয় দেখানো, সন্ত্রস্ত করে তোলা, ভীতি প্রদর্শন করা। 

পবিত্র আলকুরআনে বলা হয়েছে : 
وَأَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِن قُوَّةٍ وَمِنْ رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهِ عَدْوَّ اللّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِيْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ لاَ تَعْلَمُوْنَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ ـ
‘‘আর তোমরা যতদূর সম্ভব নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য ও পালিত ঘোড়া তাদের সাথে মুকাবিলা করার জন্য প্রস্ত্তত করে রাখ যেন তার সাহায্যে আল্লাহ এবং নিজেদের দুশমনদের আর অন্যান্য এমন সব শত্রুদের ভীত শংকিত করতে পার যাদেরকে তোমরা জান না। কিন্তু আল্লাহ জানেন।’’ 

পারিভাষিক অর্থে ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে চোরা গোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, হত্যা করা, আত্মঘাতী হামলা কিংবা কোন নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে জঙ্গিবাদ বলে।

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ : পূর্বের অনুচ্ছেদে জঙ্গিবাদের সংজ্ঞা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের পার্থক্য তুলে ধরা হচ্ছে। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ ত্রাস শব্দ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হল ভয়, ভীতি, শংকা। সন্ত্রাস হল আতংকগ্রস্ত করা, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর সন্ত্রাসবাদ হল, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠান নীতি। এর অর্থ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা হয়েছে : The systematic use of violance to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective. 

অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে কোন জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রণালীবদ্ধ সহিংসতার মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা। আরবী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে : 

‘‘অর্থাৎ ভয়ভীতি সঞ্চারের লক্ষ্যে শক্তি প্রয়োগ করা অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে হুমকি প্রদর্শন করা। 
‘বিশ্ব মুসলিম সংস্থার’ অধীন ‘ইসলামী ফিক্হ্ কাউন্সিল’ ১৪২২ হিজরীতে পবিত্র মক্কা নগরীতে অনুষ্ঠিত ১৬তম অধিবেশনে সন্ত্রাসের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা হচ্ছে,

অর্থাৎ ‘কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্র কোন মানুষের ধর্ম, বিবেক বুদ্ধি, ধন-সম্পদ ও সম্মান-মর্যাদার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে শত্রুতার চর্চা করে তাকে সন্ত্রাস বলে।’ 
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা যে জিনিসটি উপলব্ধি করেছি তা হল সাধারণত অন্যায়ভাবে যে কোন ভীতি প্রদর্শন, ক্ষতি-সাধন, হুমকি সৃষ্টি ইত্যাদি অপরাধমূলক আচরণকে সন্ত্রাস বলে।
জঙ্গিবাদের উত্থান

ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস এটি কিন্তু নতুন বিষয় নয়। প্রাচীন কাল থেকে তা চলে আসছে। ইয়াহুদী উগ্রবাদী ধার্মিকগণ ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসে প্রাচীন যুগের প্রসিদ্ধতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল ইয়াহুদী যীলটদের সন্ত্রাস। খৃস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসকারী উগ্রবাদী এ সকল ইয়াহুদী নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপোসহীন ছিল। যে সকল ইয়াহুদী রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহ অবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। প্রয়োজনে এরা আত্মহত্যা করত, কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে ধরা দিত না। 

মধ্যযুগে খৃস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা দেখা যায়। বিশেষতঃ ধর্মীয় সংস্কার, পাল্টা সংস্কার এর যুগে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ছাড়াও সন্ত্রাসের অনেক ঘটনা দেখা যায়। ইসলাম ধর্মের প্রথম যুগে জঙ্গিবাদের কিছু ঘটনা উল্লেখ করার মত। ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬ খৃ.) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান উসমান (রা) কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এক পর্যায়ে আলী (রা) খিলাফাতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অধিকাংশ সাহাবী আলী (রা)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু তৎকালীন সিরিয়ার গবর্ণর মুয়াবিয়া (রা)সহ কিছু সাহাবী আলী (রা)-এর আনুগত্য অস্বীকার করেন। মুয়াবিয়া (রা) দাবি করেন যে, আগে উসমান (রা)-এর হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আলী (রা) বলেন যে, রাষ্ট্রিয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পূর্বে হত্যাকারীদের বিচার শুরু করলে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে পারে। 

মুয়াবিয়া (রা) এই মত প্রত্যাখান করার কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। এটাই ছিফ্ফিন যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে উভয় পক্ষের বহু লোক হতাহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (রা)-এর মাঝে আপোস-মীমাংসার পর একটি সালিসী কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু আলী (রা)-এর অনুসারীদের একদল লোক তাঁর পক্ষ ত্যাগ করে মানুষের বিচার মানতে অস্বীকার করে। ইতিহাসে এ দল ‘খারেজী’ নামে পরিচিত। তারা আওয়াজ তোলে (إنِِ الْحُكْمُ إلاَّ للهِ) আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য আইন নেই।

 তারা আরো দাবী করে যে, একমাত্র আল্লাহর আইন ও আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছু চলবে না। তারা বলে, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন অবাধ্যদের সাথে লড়তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন : 
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأخْرَى فَقَاتِلُوْا الَّتِىْ تَبْغِىْ حَتَّى تَفِئَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوْا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَــ
‘‘মু’মিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর অত্যাচার বা সীমালঙ্ঘন করলে তোমরা অত্যাচারী দলের সাথে যুদ্ধ কর যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দেবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে পছন্দ করেন।

 তারা উল্লেখ করে, আল্লাহ এখানে নির্দেশ দিয়েছেন যে, সীমালঙ্ঘনকারী দলের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারা বলে মুয়াবিয়ার (রা) দল সীমালঙ্ঘনকারী, কাজেই এদের আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে মানুষকে সালিস করার ক্ষমতা প্রদান অবৈধ। অতঃপর তারা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করল। বসরা ও কুফা হতে এসে সারা দেশে গোলযোগ শুরু করল। প্রথমে তারা মাদায়েন শহর অবরোধের চেষ্টা করে। এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে তারা নাহরাওয়ান নামক স্থানে সমবেত হয় আলী (রা)-এর সাথে যুদ্ধ করতে। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০০। আলী (রা) তাদেরকে বুঝালেন অস্ত্র সংবরণ করতে। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রায় ১৮০০ খারেজি কিছুতেই আলীর (রা) বিরুদ্ধে অস্ত্র সংবরণ করতে রাজী হলো না। ৬৫৯ খৃস্টাব্দে তারা আলী (রা) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়। যাকে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ বলা হয়। কিন্তু তাদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নাহরাওয়ান যুদ্ধের পর খারেজীরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিজেদের মতবাদ প্রচার করতে থাকে। আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে তারা মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল।

 এই খারেজীরা পরবর্তিতে আলী (রা), মুয়াবিয়া (রা) ও আমর ইবনুল আস (রা) কে একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন স্থানের মসজিদে হত্যার পরিকল্পনা করে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমর ইবনুল আস (রা) সেদিন মসজিদে আসেননি, তাই তাঁর জীবন রক্ষা পেল। মুয়াবিয়া (রা) বেঁচে যান, তবে তিনি সামান্য আঘাত পান। অন্যদিকে আলী (রা) মসজিদে নামায পড়তে যাওয়ার সময় আততায়ী আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম খারেজীর তরবারির আঘাতে ১৭ই রমাদান ৪০ হিজরী তারিখে শাহাদাত বরণ করেন। এথেকেই মুসলিদের মধ্যে জঙ্গিবাদ, ইসলামের নামে গুপ্ত হত্যা শুরু হয়। এই খারেজীদের সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, এদের প্রায় সকলেই ছিলো যুবক, অত্যন্ত ধার্মিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান, সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় করতো। সারাদিন যিকর ও কুরআন পাঠে রত থাকতো। তাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়ে গেলে শুধু কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজই শুনা যেত। কুরআন পাঠ করলে বা শুনলে তারা আল্লাহর ভয়ে ও আবেগে কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে যেত। এজন্য তাদেরকে কুররা বা কুরআন পাঠকারী দল বলে অভিহিত করা হতো। পাশাপাশি এরা অত্যন্ত হিংস্র ও সন্ত্রাসী ছিল। অনেক নিরপরাধ মুসলিম তাদের হাতে প্রাণ হারায়। এরা মনে করত যে, ইসলামী বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলেই মুসলিম ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হয়। এমন ব্যক্তি দেরকে গুপ্ত হত্যা করা বৈধ। শুধু তাই নয় যারা আলী (রা) কে কাফির মনে করতো না এরূপ সাধারণ অযোদ্ধা, পুরুষ, নারী ও শিশুদেরও এরা হত্যা করত। ইসলামের ইতিহাসে আরেকটি সংগঠনের অস্তিত্ব দেখা যায় যারা খারেজী ফিরকার মত ভিন্নমতালম্বীদের গুপ্ত হত্যা করত, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করত, নিজেদেরকে সত্যিকার মুসলিম মনে করত, এদেরকে ‘বাতেনী হাশাশীন’ নামে অভিহিত করা হত। 

জঙ্গিবাদ বনাম জিহাদ:মুসলিম জঙ্গিবাদী বিপথগামীরা সাধারণত তাদের কর্মকান্ডের জন্য ইসলামের পবিত্র পরিভাষা জিহাদ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। তারা জিহাদের নামেই তাদের অধিকাংশ কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, কোন কোন ক্ষেত্রে কিতালের প্রসঙ্গ তুলে ধরছে। অথচ এই জিহাদ ও কিতাল বৈধ কোন কর্তৃপক্ষ ছাড়া অর্থাৎ রাষ্ট্র বা সরকার ছাড়া কেউ ঘোষণা দিতে পারে না। এ বিষয় আলোচনা করতে হলে প্রথমে আমাদেরকে জিহাদ ও কিতালের তাৎপর্য বুঝতে হবে। 

জিহাদের মূল শব্দ হলো (جُهْدٌ) জুহদুন। যার শাব্দিক অর্থ চেষ্টা করা, প্রচেষ্টা চালানো। পারিভাষিক অর্থ হলো চূড়ান্ত বা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। আর ইসলামিক পরিভাষায় ও ইসলামী ফিক্হে জিহাদ বলতে মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধকেই বুঝানো হয়। জিহাদ একটি সাধারণ ও ব্যাপকার্থক শব্দ। আলকুরআন ও আল হাদীসে জিহাদকে বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ তুলে ধরা হলো। যেমন আলকুরআনে বলা হয়েছে-
(وَجَاهِدُوْا فِى اللَّهِ حَقَّ جِهَادِه ) 
‘‘তোমরা আল্লাহর জন্যে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিত।’’ 

আবদুল্লাহ ইবন আববাস (রা) বলেন : এখানে ‘‘হাক্কা জিহাদিহি’’ অর্থ হল- জিহাদে পূর্ণ শক্তি ব্যয় কর এবং তিরস্কারীর তিরস্কারে কর্ণপাত কর না। দাহ্কাক ও মুকাতিল (রহ) বলেন : আল্লাহর জন্য কাজ কর যেমন করা উচিত। এবং আল্লাহর ইবাদাত কর যেমন করা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন : এখানে জিহাদ নিজ প্রবৃত্তি ও অন্যায় কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে কাজ করাকে বুঝানো হয়েছে। 
আরেক জায়গায় কাফির ও মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ করাকে জিহাদ বলা হয়েছে। 
মহান আল্লাহ বলেন : 
ياَ اَيُّهَا النَّبِىُُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْــ
‘হে নবী, কাফির ও মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন।’ 

কষ্ট স্বীকার ও ধৈর্য ধারণের অর্থে জিহাদ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন : 
وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ إِنَّ اللَّهَ لَغَنِىُّ عَنِ الْعَالَمِيْنَ ــ
‘যে কষ্ট স্বীকার করে, সে তো নিজের জন্যই কষ্ট স্বীকার করে। আল্লাহ বিশ্ববাসী থেকে অমুখাপেক্ষী।’ 
وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَــ
‘‘আর যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।’’ 
فَلاَ تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيْرًاــ
‘‘অতএব আপনি কাফিরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সাথে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম করুন। 

উপরোক্ত তিনটি আয়াতে মুসলিমদেরকে যুল্ম নির্যাতনের সময় ধৈর্যধারণ করতে বলা হয়েছে। অনুরূপ ভাবে অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য ন্যায়ের কথা বলাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে- 

‘‘একজন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাস করলেন : সর্বোত্তম জিহাদ কোনটি? তিনি বললেন : অত্যাচারী শাসকের নিকট সত্য ও ন্যায়ের কথা বলা।’’ 
হজকে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ বলা হয়েছে- 

‘পুণ্যময় হজ্জ হলো সর্বোত্তম জিহাদ।’ 

জিহাদের আরেকটি সমার্থক শব্দ হচ্ছে قتال (কিতাল)। কিতাল অর্থ পরস্পর যুদ্ধ করা, লড়াই করা। আলকুরআন ও আল হাদীসে বিভিন্ন জায়গায় কিতালের কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন : 
وَقَاتِلُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللّهِ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوْا إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَــ
‘‘আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’’ অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেছেন : 
وَقَاتِلُوْا الْمُشْرِكِيْنَ كَآفَّةً كَمَا يُقَاتِلُوْنَكُمْ كَآفَّةًــ
‘‘আর তোমরা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে।’’ 

উপরোক্ত আলোচনায় জিহাদ শব্দটি যে ব্যাপক অর্থবোধক তা আমাদের সামনে স্পষ্ট। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থে এটি প্রয়োগ করা হয়েছে। 

বস্ত্ততঃ জিহাদের কাজ শুরু হয় মানুষের ব্যক্তি জীবনের আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টার মাধ্যমে। তারপর নিজের আত্মীয় স্বজন ও অন্যান্য মানুষের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যমে। এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক অব্যাহত প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া। সর্বশেষ প্রয়োজনে যুদ্ধের মাধ্যমে জিহাদের অর্থ প্রকাশ পেয়ে থাকে। আর সেটি হবে সামনা সামনি যুদ্ধ যা কিতাল এবং তা হবে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের আদেশে এবং তাঁর নেতৃত্বে। সেজন্য ইসলাম জিহাদ ও কিতালের ক্ষেত্রে অনেক শর্ত আরোপ করেছে। যার অন্যতম শর্ত হলো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। রাষ্ট্রের প্রধান বা নেতাই জিহাদের বা কিতালের ঘোষণা দিতে পারেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : 

‘‘রাষ্ট্রপ্রধান হলো ঢাল, তাঁর পেছনে থেকেই যুদ্ধ করতে হবে।’ 
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে : 

‘‘রাষ্ট্র প্রধান ধার্মিক হোক অথবা অধার্মিক হোক উভয় ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্যে জিহাদ করা তোমাদের উপর কর্তব্য।’’ যদি কোন দল বা গোষ্ঠীকে অথবা কোন দল বা আমীরকে জিহাদ বা কিতালের ঘোষণা দেয়ার অধিকার দেয়া হয় তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, মারামারি ও গোলযোগ শুরু হয়ে যাবে। এভাবে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে যার পরিণতিতে দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (রা)-এর মাঝে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ। বৈধ চতুর্থ খলিফা আলী (রা)-এর আনুগত্য না করার কারণেই আলী (রা) মুয়াবিয়া (রা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তদরূপ উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা)-এর যুদ্ধও রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ ছিল।

 আত্মঘাতী হত্যার মাধ্যমে মানুষদেরকে হত্যা করা, নিরীহ জনগণকে হত্যা করা, কিংবা গুপ্ত হত্যা করা, পেছন থেকে হত্যা করা, বোমাবাজি করে মানুষ হত্যা করা, জান-মাল ধ্বংস করা কিছুতেই জিহাদ হতে পারে না। বিগত দেড় হাজার বৎসর ধরে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ‘জিহাদ’ নামে এরূপ অপকর্ম কখনোই দেখা যায়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোথাও কোন নিষ্ঠাবান মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে বা দলগতভাবে কাউকে গুপ্ত হত্যা করেছে, আত্মহত্যার মাধ্যমে মানুষ হত্যা করেছে, কারো বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছে, কোন জনপদে বোমাবাজি ও অরাজকতা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, ইত্যাদির কোন নজির দেখা যায় না। সুতরাং জঙ্গিবাদী কর্মকান্ডকে জিহাদের নামে চালিয়ে দেয়া মোটেও বৈধ নয়। আলকুরআনে জিহাদ ও তৎসম্পর্কিত শব্দ ৩৬বার এসেছে এবং প্রতিবারই ন্যায়নীতির সংগ্রামের কথা বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে জঙ্গিবাদ হলো অন্যায়ভাবে মানুষদেরকে আক্রমণ করা, তাদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং নিরীহ লোকজনকে হত্যা করা ইত্যাদি।

ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ: বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে জঙ্গিবাদের যে উত্থান ও তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, তার সাথে শুধু গুটি কতেক মুসলিম জড়িত। বিশ্বের সকল বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদগণ এবং মূলধারার সকল ইসলামী সংগঠন ও সংস্থা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, এধরনের ব্যক্তিরা বিভ্রান্ত, বিপথগামী। এরা ইসলামের শত্রুদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। ইসলামের শত্রুরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ওরা এদেরকে ইসলামের ভাব-মর্যাদা ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করছে। এসকল ব্যক্তি কোনভাবেই ইসলামের জন্য কল্যাণকর হতে পারেনা। তারা ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে বিকৃত ও কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়। 

জঙ্গিবাদীরা সাধারণত সে সকল জঘন্য কর্মকান্ড ঘটিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে হাসিল করতে চায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- (ক) বোমাবাজি করে অরাজকতা সৃষ্টি করা। (খ) মানুষ হত্যা ও (গ) আত্মঘাতী হামলা। 
বোমাবাজি ও অরাজকতা সৃষ্টি করা :

জঙ্গিবাদীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন ধরনের জঘন্য কর্মকান্ড সংগঠিত করে থাকে, তার মধ্যে একটি হল বোমাবাজি করে অরাজকতা সৃষ্টি করা, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ করা, দাংগা-হাংগামা করা। পবিত্র কুরআনে এগুলোকে ‘ফিতনা’ ও ‘ফাসাদ’ শব্দদয় দ্বারা অভিহিত করা হয়েছে। ফিতনা-ফাসাদ মহান আল্লাহর কাছে অতীব ঘৃণিত একটি মহাপাপ, কবীরা গুনাহ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ সমস্ত কাজকে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এগুলোর জন্যে ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন : 

‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর বিপর্যয় ঘটাবে না।’ 
وَلاَ تَعْثَوْْا فِى الأَرْضِ مُفْسِدِيْنَــ
‘তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ তথা দাংগা হাংগামা করে বেড়িও না।’ 

‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়িও না।’ 
وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ وَلاَ تَبْغِ الْفَسَادَ فِىْ الأَرْضِ إِنَّ اللَّهَ لاَ يُحِبُّ الْمُفْسِدِيْنَ 
‘তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অুনগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ, বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ 

‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারী, দুষ্কর্মীদের কর্ম সার্থক করেন না।’ 
মহান আল্লাহ ফিত্না সম্পর্কে ইরশাদ করেন : 
وَصَدٌّ عَنْ سَبِيْلِ اللّهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِنْدَ اللّهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَِتْلِــ
‘আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা, মসজিদে-হারামের পথে বাধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিষ্কার করা, আল্লাহর নিকট বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফিতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ। 
وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ـ
‘আর ফিতনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ 

উপরোক্ত আয়াতসমূহে ফিতনা-ফাসাদ তথা অরাজকতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা, বোমাবাজি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ফিতনা-ফাসাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা জঙ্গিবাদকে হত্যার চেয়েও কঠিন ও গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের অপরাধ হত্যার সমতুল্য। এ প্রসঙ্গে তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘নর হত্যা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য কাজ কিন্তু কোনো মানবগোষ্ঠী বা দল যখন জোরপূর্বক নিজের স্বৈরতান্ত্রিক ও যুল্মতান্ত্রিক চিন্তাধারা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়, সত্য গ্রহণ থেকে লোকদেরকে জোরপূর্বক বিরত রাখে এবং যুক্তির পরিবর্তে পাশবিক শক্তি প্রয়োগে জীবন গঠন ও সংশোধনের বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত প্রচেষ্টার মুকাবিলা করতে শুরু করে তখন সে নরহত্যার চাইতেও জঘন্যতম অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। 

এছাড়া পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা আল্লাহ ঘোষণা করেন : 
إِنَّمَا جَزَاء الَّذِيْنَ يُحَارِبُوْنَ اللّهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَسْعَوْنَ فِى الأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوْا أَوْ يُصَلَّبُوْا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيْهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِّنْ خِلافٍ أَوْ يُنْفَوْا فِى الأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْىٌ فِى الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِى الآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌــ
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে হাঙ্গামা করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা। আর আখিরাতে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ 

মানব হত্যা: জঙ্গিবাদীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আরেকটি জঘন্য অপরাধ করে থাকে তা হলো মানব হত্যা। এটা বিভিন্নভাবে করে থাকে, গুপ্তভাবে, পেছন থেকে, বোমা মেরে কিংবা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দিয়ে। অথচ মানব জীবন মহান আল্লাহর নিকট অত্যন্ত সম্মানিত ও পবিত্র। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন :
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِىْ آدَمَ وَحَمَلْنهُمْ فِىْ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنهُمْ مِّنَ الطَّيِّبتِ وَفَضَّلْنهُمْ عَلَى كَثِيْرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلاً
নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্ত্তর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। 

সেজন্য মহান আল্লাহ একজন মানবের জীবন সংহারকে সমগ্র মানবগোষ্ঠীর হত্যার সমতুল্য সাব্যস্ত করেছেন। মানব জীবনের নিরাপত্তার প্রতি ইসলাম যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য কোন ধর্মে বা মতাদর্শে এর নযির নেই। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন :
مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِىْ إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِى الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيْعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعًاــ
‘এ কারণে আমি বনী ইসরাইলকে এরূপ লিখে দিয়ে ছিলাম যে, যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে কিংবা ভূ-পৃষ্ঠে কোন গোলযোগ সৃষ্টি করা ছাড়াই কাউকে হত্যা করলো সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই হত্যা করলো আর যে ব্যক্তি কোন একজন মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই রক্ষা করলো।’ 
যে ব্যক্তি সংগত কারণ ছাড়া একজন মানুষকে হত্যা করে সে কেবল একজন মানুষকেই হত্যা করে না, বরং সে সমগ্র মানবতাকে হত্যা করে, অর্থাৎ সে একজন মানুষকে হত্যা করে এ কথাই প্রমাণ করলো যে তার মন-মানসিকতায়, চিন্তা-চেতনায় অন্য মানুষের প্রতি সামান্যতম সম্মান, মর্যাদাবোধ ও সহানুভূতির চিহ্ন নেই। 

সেজন্য মহান আল্লাহ সংগত কারণ ছাড়া মানব হত্যা যেভাবেই হোক না কেন নিষিদ্ধ করেছেন। নিম্নে এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন ও হাদীস হতে কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হলো। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন : 

‘আল্লাহ যে প্রাণকে হারাম করেছেন তাকে ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া হত্যা করো না।’ 
ন্যায়সংগত কারণ তিনটি যা ইমাম আল বুখারী (র) ও ইমাম মুসলিম (র) আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের (রা) রিওয়ায়াতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : 
‘যে মুসলিম আল্লাহ এক এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দেয়, তার রক্ত হালাল, কিন্তু তিনটি কারণে তা হারাম হয়ে যায়। 
(১) বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সে যদি যিনা করে, তবে প্রস্তর বর্ষণে হত্যা করাই তার শরীয়তসম্মত শাস্তি। 
(২) সে যদি অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে হত্যা করে, তবে তার শাস্তি এই যে, কিসাস হিসেবে তাকে হত্যা করা হবে। 
(৩) যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে, তার শাস্তিও হত্যা।’ (আলোচ্য হাদীসে এবং তৎসম্পর্কিত কুরআনের আয়াতে কিসাস নেয়ার অধিকার নিহত ব্যক্তির অভিভাবককে দেয়া হয়েছে। যদি তার রক্ত সম্পর্কিত কোন অভিভাবক না থাকে তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার প্রধান এ অধিকার পাবে। কারণ সরকারও একদিক দিয়ে সকল মুসলিমের অভিভাবক।)

কেউ কেউ ন্যায় সংগত হত্যার কারণ উপরোক্ত তিনটির সাথে আরো তিনটি বর্ণনা করেন : তাহলো-
(৪) জিহাদের ময়দানে সত্যদ্বীনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের হত্যা করা।
(৫) ডাকাতি অথবা রাজপথে রাহাজানি ইত্যাদি অপরাধের শাস্তি স্বরূপ হত্যা করা।
(৬) কোন ব্যক্তি যদি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে জঙ্গিপন্থা অবলম্বন, সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি, জনজীবনে আতঙ্ক-অশান্তি সৃষ্টি করে এবং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন ঘটানোর চেষ্টা করে তাকে হত্যা করা। 
তবে উপরোক্ত ছয়টি কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানুষকে হত্যা করা যায় না। কিন্তু এ সকল অবস্থায় মৃত্যু দন্ড কার্যকর করার অধিকার শুধু রাষ্ট্রীয় সরকার বা কর্তৃপক্ষের জন্য নির্ধারিত, অর্থাৎ আদালত রায় দেবে আর সরকার কর্তৃক নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারীরা তা বাস্তবায়ন করবে। জনগণকে কোন অবস্থাতেই আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়নি।

 মহান আল্লাহ ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া মানব হত্যা নিষিদ্ধ সম্পর্কে আরো ঘোষণা করেন : 
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيْهَا وَغَضِبَ اللّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَه عَذَابًا عَظِيْمًاــ
‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানেই সে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তার উপর অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্ত্তত করে রাখবেন।’ 
وَالَّذِيْنَ لاَ يَدْعُوْنَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا اخَرَ وَلاَ يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِىْ حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلاَ يَزْنُوْنَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًاـــيُضعَفْ لَه الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيْهِ مُهَانًا 
‘এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের ইবাদাত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করবে তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কিয়ামাতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।’
নিম্নে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো, যা সুস্পষ্টভাবে ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া মানব হত্যাকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন : 

‘হে লোক সকল! তোমাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর উপর তোমাদের হস্তক্ষেপ হারাম করা হলো, তোমাদের আজকের এই দিন, এই (যিলহজ্জ) মাস এবং এই (মক্কা) নগরী যেমন পবিত্র ও সম্মানিত, অনুরূপভাবে উপরোক্ত জিনিসগুলোও সম্মানিত ও পবিত্র। সাবধান! আমার পর তোমরা পরস্পরের হন্তারক হয়ে কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যেও না’ 

‘তোমরা সাতটি সর্বনাশা গুনাহ থেকে বিরত থাক। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, যাদু করা, শরীয়াতের বিধিবর্হিভূত কোন অবৈধ হত্যাকান্ড ঘটানো, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, সুদ খাওয়া, যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানো এবং সরলমতি সতী মহিলাদের ওপর ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া।’ 

‘যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি : আল্লাহর নিকট (বিনা অপরাধে) কোন মু’মিনের হত্যাকান্ড সমগ্র পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা।’ 

‘কোন মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়ার তুলনায় সমগ্র পৃথিবীর পতন আল্লাহর দৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। 

‘মুমিন যে পর্যন্ত অবৈধভাবে কাউকে হত্যা না করে, সে পর্যন্ত সে ইসলামের উদারতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।’
আল কুরআনের উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসমূহ ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া মানুষ হত্যাকে কোনভাবেই সমর্থন করে না, বরং সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করে, অধিকন্তু ন্যায় সংগত হত্যার বিধান রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করবে, কোন দল বা গোষ্ঠীকে এই অধিকার দেয়া হয়নি। যারা এ ধরনের কাজ করবে তাদের পরিণাম হবে জাহান্নাম। 

আত্মঘাতী হামলা বা সুইসাইড স্কোয়াড: জঙ্গিবাদীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অপর যে জঘন্য কর্মটি করে থাকে সেটা হলো আত্মঘাতী হামলা। আর এটি করে সাধারণতঃ সুই সাইড স্কোয়াড বা আত্মঘাতী দল গঠনের মাধ্যমে। কিছু সহজ-সরল সাদাসিধে মুসলিমকে জান্নাত পাবার লোভ, কিংবা অন্যান্য পুরস্কারের কথা বলে এ কাজে নিয়োজিত করে থাকে। অথচ মহান আল্লাহ যে ভাবে অপরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন, সেভাবে নিজের জীবনকেও ধ্বংস করতে নিষেধ করেছেন। আত্মহত্যা করতে বারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত ও হাদীস উদ্ধৃত করা হলো। মহান আল্লাহ ইরশাদ 
করেন : 
وَلاَ تُلْقُوْا بِأَيْدِيْكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِــ
‘তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না।’ 
وَلاَ تَقْتُلُوْا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيْمًاــ
‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর দয়ালু।’ 

‘যে ব্যক্তি নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করবে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামে নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করবে। আর যে নিজেকে আঘাত করবে (আত্মহত্যা করবে), সে জাহান্নামেও নিজেকে আঘাত করবে।’ 

‘যে ব্যক্তি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামে বসেও সে অনবরত উচ্চ স্থান থেকে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে বসেও সে অনন্তকাল ধরে বিষ পান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন লোহার অস্ত্র দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে বসে অনন্তকাল ধরে সেই অস্ত্র দিয়েই নিজেকে কোপাতে থাকবে। 

‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই সে এক খানা ছুরি দ্বারা নিজের দেহে আঘাত করলো। ফলে রক্তপাত হয়ে সে মারা গেল, তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার বান্দা আমাকে ডিংগিয়ে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম
‘যে ব্যক্তি কোন জিনিস দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামাতের দিনও তাকে সে জিনিস দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে। কোন মু’মিনকে অভিশাপ দেয়া তাকে হত্যা করার শামিল, আর কোন মু’মিনকে কাফির বলা তাকে হত্যা করার শামিল।’ 

পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত কয়েকটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীসের আলোকে আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কোন অবস্থায় আত্মহত্যা করা যাবে না। আত্মঘাতী হামলা করে মানুষ হত্যা তো দূরের কথা, উপরোক্ত আলোচনায় আরো স্পষ্ট হয়, যারা এই অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হবে তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। 


জঙ্গিবাদ দমনে করণীয়: আমরা মনে করি জঙ্গিবাদ কোন বড় ধরনের সমস্যা নয়। গুটি কতেক ব্যক্তি এর সাথে জড়িত। এরা অসংগঠিত ও অপরিকল্পিত। যদি সদিচ্ছার সাথে কিছু সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেয়া যায় তাহলে এ সমস্যাটি সহজে দূর করা যাবে বলে বিশ্বাস করি, নিম্নে এ লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হলো। 
এদেরকে হিদায়াতের জন্য আলিম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের সম্পৃক্ত করতে হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে যে, জঙ্গিবাদ কোনক্রমেই ইসলামের পথ নয়। এটা সম্পূর্ণভাবে জাহান্নামের পথ। 

দেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদের ইমাম খতিবদের সহযোগিতা নিতে হবে, তারা যেন জুমার খুতবায় ও অন্যান্য সময়ে মসজিদগুলোতে জঙ্গিবাদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমদেরকে অবহিত করতে পারেন। 

জনগণকে সাথে নিয়ে এই জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে। তাই জনগনের বিশ্বাস, ধর্ম-বিশ্বাস, তাদের লালিত মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে সম্মান করতে হবে। এ সবের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 


আমরা সকলে জানি, ইসলাম অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা ও মহান আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করা। মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন মানবকুলের শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, প্রগতি ও উন্নতির জন্য মনোনিত করেছেন ইসলাম ধর্মকে, অতএব একজন মুসলিম অপর মুসলিমের অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে না। তাইতো একজন আরেক জনের সাথে দেখা হতেই ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সম্বোধন করে। যার অর্থ ‘‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’’ তাহলে কিভাবে সে অন্যকে অশান্তিতে ফেলে দেবে? অন্যের নিরাপত্তায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে? সুতরাং ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদের কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্বের এমনকি বাংলাদেশেরও কোন প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত ইসলামী দল বা প্রতিষ্ঠান কোন ধরনের জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত নেই। শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় হাজার বছর অপেক্ষা করতে হলেও তা করা উচিত। জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দিয়ে একে তো দ্রুত ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, আর করা গেলেও তার কোন শুভ ফল আশা করা যায় না। এ কথা সর্বমহলে স্বীকৃত যে, ইসলাম তার অন্তর্নিহিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, তরবারি, জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয়। তবে নতুন গজিয়ে ওঠা কিছু গ্রুপ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। তারা জিহাদের নামে ইসলামের নামে বিভিন্ন অরাজকতামূলক কর্মকান্ড সংগঠিত করছে। অথচ এগুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, যা আমরা ইতিপূর্বে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে বুঝতে পেরেছি। ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ হারাম। বোমাবাজি, মানুষ হত্যা, সন্ত্রাস, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি ও আত্মঘাতী তৎপরতা ইত্যাদি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা এগুলো করছে তারা বিভ্রান্ত, ইসলাম বিরোধীদের ক্রীড়নক। এদের চিহ্নিত করে প্রতিহত করা প্রয়োজন। 


রেফারেন্সঃ.
. আহমদ শরীফ সম্পাদিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-২১৬।
. মোহাম্মদ আলী ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা-ইংরেজী অভিধান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা-২১৬।
. A. S. Hornby, Oxford Advanced Learner’s Dictionary, Oxford University Press, 5th edition, 1995. Page-738.
. A. M. Macdonald, Chambers Twenticth Century Dictionary, The Pitman Press, Great Britain, 1981, Page- 430.
. প্রাগুক্ত।
. আল্ কামূসুল্ আস্রী, ইলিয়াস আনতুন ইলিয়াস, দারুল জাইল, বৈরুত, পৃষ্ঠা- ২৬৫।
. সূরা আল্ আন্ফাল : ৬০।
. বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা-২৬৬।
. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, কলকাতা : সাহিত্য সঙসদ, ২২তম মুদ্রণ, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা-৬৬১।
. বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা-৫৪১।
. The New Encyclopaedia Britannica, USA-2002, Vol. II, Page- 650.
. ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস, নূরুল ইসলাম, মাসিক পৃথিবী, ফেব্রুয়ারী, ২০০৯, পৃষ্ঠা-৩৮।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৮।
. দৈনিক প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০০৯।
. দৈনিক যুগান্তর, ২ এপ্রিল ২০০৯।
. দৈনিক প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০০৯।

. ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আস্ সুন্নাহ পাবলিকেসন্স, ঝিনাইদহ, আগস্ট, ২০০৬, পৃষ্ঠা-১১।
. Encyclopaedia Britannica, Articles : Terroresm, Zealet and Ideology. 
. ইসলামের ইতিহাস, কে আলী, আজিজিয়া বুক ডিপো, ঢাকা, পঞ্চদশ সংস্করণ, অষ্টম প্রকাশ, ২০০৭, পৃষ্ঠা-১৫৬।
. ‘খারেজী’ অর্থ দল ত্যাগী। এরা হারুরীয় নামে অভিহিত হয়ে থাকে, কারণ এরা হারুরা গ্রামেই প্রথমে মিলিত হয়ে হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে এবং তাঁর দল ত্যাগ করে। খারেজী ইসলামের একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায়, তারা কেবল আবু বকর (রা) ও উমার (রা)কে আইন সম্মত খলীফা মনে করত এবং অপর সকলকে বলপূর্বক খিলাফত দখলকারী বলে অভিহিত করত। তারা রাজনীতিতে গণতন্ত্রী এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে গোঁড়া ছিল। (ইসলামের ইতিহাস, কে আলী, পৃষ্ঠা-১৭২)
. সূরা ইউসুফ : ৪০ ও ৬৭।
. সূরা আল্ হুজুরাত : ৯।
. ইসলামের ইতিহাস, কে আলী, পৃষ্ঠা : ১৭২-১৭৩।
. ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, ড. খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পৃষ্ঠা : ১৭২-১৭৩।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ২৮।
. এরা হলো ইসমাঈলীয়া ফাতিমীয়া শিয়া মতবাদের ইমাম মুনতাসির বিল্লাহ (৪৮৭)-এর জেষ্ঠ্য পুত্র নিযার-এর খলিফা হাসান ইবনু সাবাহ নামক এক ইরানীর অনুসারী। এরা প্রচার করে যে, মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি বা বিবেক দিয়ে আলকুরআন ও ইসলামের নির্দেশ বুঝা সম্ভব নয়। আলকুরআনের সঠিক ও গোপন ব্যাখ্যা বুঝতে ইমামের মতামতের উপরই নির্ভর করতে হবে। আর সেই ইমাম লুকায়িত আছেন। তার প্রতিনিধি হিসেবে হাসান নিজে কাজ করছেন। তিনি তার ভক্তদের মধ্যে হতে একদল আত্মঘাতী ফিদায়ী তৈরি করেন। যারা তার নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে আত্মহননসহ যে কোন কাজের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। ইমাম যাকেই শত্রু মনে করতেন তাকে গুপ্ত হত্যা করার নির্দেশ দিতেন। হাসানের মুত্যৃর পরও এরা তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে, তৎকালীন মুসলিম শাসকগণ এদের দমনে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে ৬৫৪ হিজরীতে (১২৫৬ খৃ.) হালাকু খাঁর বাহিনী এদেরকে নির্মূল করে। (ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পৃষ্ঠা- ২৮)।
. ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস : কারণ ও প্রতিকার, বি. এম মফিজুর রহমান আল আয্হারী, ইউনিক লাইব্রেরী, চট্টগ্রাম, ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৪।
. জঙ্গিবাদ, বোমা হামলা ও ইসলাম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, প্রকাশনা বিভাবগ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, ডিসেম্বর, ২০০৫, পৃষ্ঠা্-১৬।
. দৈনিক নয়া নিগন্ত, ১১.৪.০৯, পৃষ্ঠা-১৬।
. আর্ রায়েদ, জুবরান মাসউদ, দারুল ইলমে লিল্মালায়ীন, বৈরুত, লেবানন, ৩য় প্রকাশ-১৯৭৮, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৫৩১।
. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১, পৃষ্ঠা-৫৩১।
. ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ড. খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পৃ-৩৪।
. সূরা আল হজ : ৭৮, (অনুবাদ : মায়ারেফুল কুরআন, মুফতী শফী আহমাদ)।
. সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদ, ও এর প্রতিকার : ইসলামী দৃষ্টিকোন, ড. মোঃ ময়নুল হক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৪৩ বর্ষ তয় সংখ্যা; জানুয়ারী-মার্চ ২০০৪, পৃষ্ঠা-১৩। 
. সূরা আত্ তাওবা : ৭৩, সূরা আত্ তাহরীম : ৯, সূরা আল্ ফুরকান : ৫৩। 
. সূরা আল্ আনকাবুত : ৬। 
. সূরা আল্ আন্কাবুত : ৬৯।
. সূরা আল্ ফুরকান : ৫২।
. রিয়াদুস সালিহীন, আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া বিন শরফ আল্ নাবাবী, হাদীস নং- ১৯৫।
. প্রাগুক্ত, হাদীস নং- ১২৭৩।
. আর রায়েদ, জুবরান মাসউদ, পৃষ্ঠা নং- ১১৩৫।
. সূরা আল বাকারাহ : ১৯০। 
. সূরা আত্ তাওবাহ : ৩৬। 
. সহীহ আল্ বুখারী, ৩য় খন্ড, হাদীস নং- ১০৮০।
. আস্ সুনান, আবু দাউদ, ৩য় খন্ড, হাদীস নং- ১৮।
. জঙ্গিবাদ, বোমা হামলা ও ইসলাম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, পৃষ্ঠা-১৭। 
. সূরা আল্ আ’রাফ : ৫৬ : ৮৫।
. সূরা আল্ বাকারাহ্ : ৬০, সূরা হুদ : ৮৫, সূরা আশ্ শুআরা : ১৮৩, সূরা আল ‘আনকাবুত : ৩৬।
. সূরা আল্-আ‘রাফ : ৭৪। 
. সূরা আল্ কাসাস : ৭৭।
. সূরা ইউনুস : ৮১।
. সূরা আল বাকারাহ : ২১৭।
. সূরা আল বাকারাহ : ১৯১।
. তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৭, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬৯।
. সূরা আল্ মায়িদাহ : ৩৩। 
. সূরা বনী ইসরাঈল : ৭০। 
. সূরা আল্ মায়িদা : ৩২।
. সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৩, সূরা আল্-আনয়াম : ১৫১। 
. তাফসীর মাআরেফুল কুরআন, মুফতী মুহাম্মদ শাফী (র), (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) পৃষ্ঠা-৭৭৬। 
. ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস : কারণ ও প্রতিকার, বি.এম. মফিজুর রহমান আল আযহারী, পৃষ্ঠা-৬৫। 
. সূরা আন্ নিসা : ৯৩।
. সূরা আল্ ফুরকান : ৬৮-৬৯।
. সহীহ মুসলিম, كتاب الحج، باب حجة النبى صلى الله عليه وسلم ৪/৪৩২ হাদীস নং : ১৪৪/১২১৮।
. সহীহ মুসলিম, كتاب الايمان، باب بيان الكبائر وأكبرها ৩৬০, হাদীস নং : ১৪৬/৯০।
. সুনান আন নাসাঈ, كتاب تحريم الدم، باب تعظيم الدم ৭/৮৮, হাদীস নং : ৩৯৯২।
. সুনান আত্ তিরমিযী كتاب الديات، باب ماجاء فى تشديد قتل المؤمن ৪/৫৪৬, হাদীস নং : ১৩৯৫।
. সহীহ আল বুখারী, كتاب الريات، باب قول الله ومن يتقل مؤمنا ১২/১৯৪, হাদীস নং- ৬৮৬২।
. সূরা বাকারাহ : ১৯৫।
. সূরা আন নিসা : ২৯।
. সহীহ আল বুখারী, كتاب الجنائز، باب ماجاء فى قتل النفس ৩/২৬৮, হাদীস নং- ১৩৩৬।
. সহীহ আল বুখারী, كتاب الطب، باب شرب السم ১/৩৯৫, হাদীস নং- ১৭৫/১০৯।
. সহীহ আল্ বুখারী, كتاب أحاديث الأنبياء، باب ماذكر عن بنى إسرائيل ৬/৫৭২, হাদীস নং- ৩৪৬৩।
. সহী আল্ বুখারী, كتاب الأدب، باب ماينهى عن السباب واللعن ১০/৪৭৯, হাদীস নং : ৬০৪৭।

0 comments