আপাত দৃষ্টিতে শফিক সাহেব একজন ভাল মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে বিশ্রাম নেন। তাঁর
স্ত্রীও একজন আদর্শ গৃহিনী। ঘর সামলাতে সামলাতেই তাঁর দিন চলে যায়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসার কোনই কমতি নেই, তবুও তাঁরা সুখী নন।
তাঁদের প্রথম সন্তান সাত বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা গেছে। দ্বিতীয় সন্তান একবছর বয়সে নিওমোনিয়ায় মারা গেল। তৃতীয় সন্তান মানসিক প্রতিবন্দ্বী। মা বাবা তাকে 'অটেস্টিক' বলে লোকজনের কাছে পরিচয় দেন। হয়তো নিজেরাও এ থেকে কিছুটা সান্তনা খুঁজেন।
এইরকম একটি পরিবারের কথা শুনলে আপনি, একজন বাঙ্গালি ‘সামাজিক প্রাণী’ হিসেবে সবার আগে কী চিন্তা করবেন?"নিশ্চই কোন পাপ করেছিলেন, যে কারণে এই শাস্তি!"আপনার কথা কী বলবো, সামাজিক প্রাণী হিসেবে আপনার কাজই হচ্ছে আলতু ফালতু কথা বলা। শফিক সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী নিজেরাই তখন চিন্তা করবেন নিশ্চই তাঁরা জীবনে কোন বিরাট পাপ করেছেন, যে কারণে তাঁদের এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে! তাঁরা তাঁদের স্মৃতির ডায়েরির পৃষ্ঠা প্রতিদিন উল্টে হাতড়ে বেড়াবেন, যদি কোন পাপের সন্ধান পান! কারণ স্বজ্ঞানে তাঁরাতো কোন পাপ করেননি!
অথবা ধরুন এক লোকের পরপর তিনটা সন্তান ‘মেয়ে’ হলো। তখন?
আমার শ্বশুরের দুইখানা সন্তান, এবং দুইজনই মেয়ে। তাঁকে তাঁর আত্মীয়রা সারাজীবন শুনিয়ে গেছেন (এখনও কেউ কেউ শোনান) তিনি ‘অভিশপ্ত।’ আমাকে সেদিন এক মেয়ে জানালো তাঁরা সব বোন, কোন ভাই নেই, এবং তাঁর বাবাকে আত্মীয়স্বজন তথা সমাজ বলে বেড়ায়, "পাপের শাস্তি! নাহলে ছেলে হবে না কেন?"
আরেকটা মেয়ে হাসিমুখে সেদিন বলছিল, "যেদিন আমার জন্ম হয়েছিল, আমার খালা ফুপুরা কান্নাকাটি করে হাসপাতালকে একদম মরা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল! কেন মেয়ে হলো!"
আমি আবার একজনকে চিনি, যার সাত সাতজন সন্তান ছিল। বড় ছেলে মারা যায় শৈশবে, হাঁটা চলা ছেড়ে কেবল ছুটাছুটি করতে শিখেছিল বেচারা। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছেলেও মারা যায় একদম দুগ্ধপোষ্য অবস্থায়। ইংরেজিতে যে বয়সের শিশুদের "ইনফ্যান্ট" বলে।তবে তাঁর চার মেয়েই বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তাও আবার বেশিদিনের জন্য নয়। প্রথম তিন কন্যা সন্তানেরও কবর তাঁকেই দিতে হয়েছিল। মৃত্যুর সময়ে কেবল একজন মেয়েকেই জীবিত দেখে যেতে পেরেছিলেন। এবং সেই মেয়েও বাবার মৃত্যুর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পৃথিবী ত্যাগ করেন।
এই লোকের এই ভাগ্য দেখলে "বাঙ্গালি সামাজিক প্রাণীরা" কী বলবে?
কিছু বলার আগে তাঁর পরিচয় দিয়ে দেই। তিনি হচ্ছেন, হযরত মুহাম্মদ (সঃ), পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব!
প্রতিটা সন্তানের মৃত্যুর ক্ষণে যিনি একটি কথাই বলতেন, "নিশ্চই আসমান জমিন সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি যখন যাকে যা খুশি দেবার ক্ষমতা রাখেন, এবং যখন যার কাছ থেকে যা খুশি কেড়ে নেবারও ক্ষমতা শুধুই তাঁর।"
মেয়ে সন্তান-ছেলে সন্তান নিয়ে নবীজির (সঃ) কোন পক্ষপাতিত্ব ছিল না। তিনি তাঁর কন্যাদের যেরকম স্নেহ করতেন, সেটা কিংবদন্তি হয়ে আছে। তাও আবার সেই আরব 'সভ্যতায়' যেখানে মেয়েদের জন্ম হলে পিতারাই তাঁদের নিয়ে যেতেন লোকালয়ের বাইরে, এবং তাঁদের জীবিত কবর দিয়ে আসতেন!
চৌদ্দশ বছরেও মানুষ সভ্য হতে শিখেনি। যেই দেশ মঙ্গলে যান পাঠায়, সেই দেশেই শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজন "কণ্যা ভ্রুণ হত্যা" করে থাকে। বলছি প্রতিবেশী দেশের কথা। ব্যপারটা আশংকাজনক, কারণ তাঁদের দেশে যাই ঘটে, সেটাই কিছুদিন পরে আমাদের দেশেও ঘটে থাকে। পেটের ভিতরে অকারনে কন্যা সন্তান হত্যা করলে কী পাপ হয় না? ওদের কে বুঝাবে?
সন্তানের প্রাকৃতিক মৃত্যুতে নবীজি(সঃ) কিভাবে শক্ত থাকতে পারতেন? কারণ তিনি জানতেন তাঁর মালিক বিভিন্নভাবে তাঁকে পরীক্ষা করার ওয়াদা করেছেন। সুরাহ বাকারায় সেই মালিক (আল্লাহ) বলেছেন, "এবং আমি কিছু ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, জীবন এবং ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা নেব। তুমি সেসব ধৈর্য্যশীলদের সুসংবাদ দাও, যারা বিপদের সময়ে বলে, 'আমরাতো আল্লাহরই এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।' এরাই তাঁরা যাদের প্রতি তাঁদের মালিকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা বর্ষিত হয়, আর তাঁরাই সৎ পথে পরিচালিত।" (আয়াত নং ১৫৫-১৫৭ দেখে নিতে পারেন।)
আল্লাহ প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়েছেন! স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তিনি কিভাবে পরীক্ষা নিবেন! কখনও আমাদের ভয় এসে গ্রাস করবে। কখনও ক্ষুধার কষ্টে চোখে অন্ধকার দেখবো! ধনসম্পদ কখনও বেড়ে যাবে, আবার কখনও সব হারিয়ে পথের ফকির হয়ে যাব। কখনও নিজে বেঁচে গিয়ে প্রিয় মানুষদের মরতে দেখবো। আমাদের পরীক্ষা দিতে হবেই। এড়ানোর কোনই উপায় নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে মাথা নত করে মালিকের হুকুম মেনে নেয়া। ব্যস! তাইলেই পাশ!
এবং আসল কথা হচ্ছে, এছাড়া আমাদের আরতো কোন উপায়ও নেই। আমার প্রিয় কেউ মারা গেছে, তাই আমি উপরওয়ালার সিদ্ধান্তের উপর অভিমান করে 'নাস্তিক' হয়ে গেলাম! এতে কী সে ফিরে আসবে? বরং এমন দোয়া করাটাই কী ভাল নয় যে "আমার বাকি প্রিয় মানুষদের এত দ্রুত আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না।"
মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমাদের দেশে একজন মানুষের একটি সন্তান মারা গেলেই, অথবা কোন দূর্ঘটনা ঘটলে, কিংবা মেয়ে সন্তান হলে আমরা দল বেঁধে 'ব্যাক বাইটিং' শুরু করে দেই, "নিশ্চই কিছু একটা করেছে....পাপের ফল!"
তাহলে নবীজির (সঃ) সাত সাত জন সন্তান কেন এত অল্প বয়সেই মারা গেল? কেন উনার বংশধর মেয়ের মাধ্যমেই প্রবাহিত হলো? উনারতো কোন পাপের রেকর্ড চোখে পরেনা!
একজন মানুষের ক্যানসার বা এইরকম ভয়াবহ কোন রোগ হলে আমরা অতি সহজেই বলে দেই, "পাপের শাস্তি!"
তাহলে আপনার প্রিয়জনদের অথবা আপনার নিজের যখন একই রোগ হয়, তখন কেন চুপ করে থাকেন?
মজার ব্যপার হলো, আমি এমন অনেককেই চিনি, যারা সারাজীবন মানুষের দূর্বলতা, মানুষের খুঁত ধরে কথা শুনিয়েছেন। মানুষের মনে আঘাত দিয়ে মজা লুটেছেন। পরবর্তী সময়ে একটা একটা করে সবকিছুই তাঁর জীবনে ঘটেছে। What goes around, comes around আর কি। তারপরেও তাঁরা শুধরান না। বিরতিহীনভাবে পরনিন্দা চালু থাকে।
যখন আমাদের প্রতিকূলে সব যেতে শুরু করে, মনে হয় আমাদের বুঝি আল্লাহ পছন্দ করেন না। অথচ একটু চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পেতাম আমার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে আছে। "সবকিছুতেই সফল" টার্মটা কেবল হিন্দি-বাংলা সিনেমার নায়কদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
"আমি এটা পেলাম না, ও ওটা পেয়ে গেছে!" - না ভেবে বরং এইটা ভাবুন, "আমার এটা আছে, ওর সেটা নেই!"
একজন চরম ঐশ্বর্য্যশালী ব্যক্তির সাথে মিশে দেখুন, পারিবারিক সুখ কী, তা তিনি জানেন না। টাকা পয়সার অভাব নেই জীবনে, কিন্তু স্ত্রী-পুত্র-সন্তানদের সাথে তাঁর সেইরকম বন্ধন নেই। আবার উল্টো দিকে, একজন সাধারণ মধ্যবিত্তের হয়তোবা টাকা পয়সা নেই, কিন্তু তিনি যা বলেন, তাই তাঁর সন্তানরা অতি শ্রদ্ধার সাথে পালন করে।
শফিক সাহেবের তিন সন্তানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে - আপনার সন্তানদের ভাগ্যে ঘটেনি বলে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান! এবং দোয়া করুন আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে যেন তা না ঘটে।
আবার শফিক সাহেবের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বলতে গেলে, আমরা জানিনা আমাদের ভবিষ্যতে কী আছে। আল্লাহ বলেন, ভবিষ্যতের মালিক শুধুই তিনি। এবং তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য যা ভাল, সেটাই করেন।
কে জানে, তাঁর একটা ছেলে বড় হয়ে কালা জাহাঙ্গীরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতো।
আপনার ছেলে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, এইটা বেশি কষ্টকর, নাকি আপনার ছেলে শৈশবেই মারা গেছে - এই অনুভূতি বেশি কষ্টকর? এরশাদ শিকদারের মা বেঁচে থাকলে তাঁকে প্রশ্নটা করা যেত।
কাজেই, অতীতে যা ঘটে গেছে, সেটা নিয়ে আফসোস করতে করতে নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে শুধু শুধু নষ্ট করা কেন?
আমি মৃত্যু দিয়ে উদাহরণ দিলেও, যেকোন রকমের বিচ্ছেদ কিংবা ক্ষতির জন্য উপরের কথাগুলো প্রযোজ্য।
Post Written by:মঞ্জুর চৌধুরী
তাঁদের প্রথম সন্তান সাত বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা গেছে। দ্বিতীয় সন্তান একবছর বয়সে নিওমোনিয়ায় মারা গেল। তৃতীয় সন্তান মানসিক প্রতিবন্দ্বী। মা বাবা তাকে 'অটেস্টিক' বলে লোকজনের কাছে পরিচয় দেন। হয়তো নিজেরাও এ থেকে কিছুটা সান্তনা খুঁজেন।
এইরকম একটি পরিবারের কথা শুনলে আপনি, একজন বাঙ্গালি ‘সামাজিক প্রাণী’ হিসেবে সবার আগে কী চিন্তা করবেন?"নিশ্চই কোন পাপ করেছিলেন, যে কারণে এই শাস্তি!"আপনার কথা কী বলবো, সামাজিক প্রাণী হিসেবে আপনার কাজই হচ্ছে আলতু ফালতু কথা বলা। শফিক সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী নিজেরাই তখন চিন্তা করবেন নিশ্চই তাঁরা জীবনে কোন বিরাট পাপ করেছেন, যে কারণে তাঁদের এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে! তাঁরা তাঁদের স্মৃতির ডায়েরির পৃষ্ঠা প্রতিদিন উল্টে হাতড়ে বেড়াবেন, যদি কোন পাপের সন্ধান পান! কারণ স্বজ্ঞানে তাঁরাতো কোন পাপ করেননি!
অথবা ধরুন এক লোকের পরপর তিনটা সন্তান ‘মেয়ে’ হলো। তখন?
আমার শ্বশুরের দুইখানা সন্তান, এবং দুইজনই মেয়ে। তাঁকে তাঁর আত্মীয়রা সারাজীবন শুনিয়ে গেছেন (এখনও কেউ কেউ শোনান) তিনি ‘অভিশপ্ত।’ আমাকে সেদিন এক মেয়ে জানালো তাঁরা সব বোন, কোন ভাই নেই, এবং তাঁর বাবাকে আত্মীয়স্বজন তথা সমাজ বলে বেড়ায়, "পাপের শাস্তি! নাহলে ছেলে হবে না কেন?"
আরেকটা মেয়ে হাসিমুখে সেদিন বলছিল, "যেদিন আমার জন্ম হয়েছিল, আমার খালা ফুপুরা কান্নাকাটি করে হাসপাতালকে একদম মরা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল! কেন মেয়ে হলো!"
আমি আবার একজনকে চিনি, যার সাত সাতজন সন্তান ছিল। বড় ছেলে মারা যায় শৈশবে, হাঁটা চলা ছেড়ে কেবল ছুটাছুটি করতে শিখেছিল বেচারা। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছেলেও মারা যায় একদম দুগ্ধপোষ্য অবস্থায়। ইংরেজিতে যে বয়সের শিশুদের "ইনফ্যান্ট" বলে।তবে তাঁর চার মেয়েই বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তাও আবার বেশিদিনের জন্য নয়। প্রথম তিন কন্যা সন্তানেরও কবর তাঁকেই দিতে হয়েছিল। মৃত্যুর সময়ে কেবল একজন মেয়েকেই জীবিত দেখে যেতে পেরেছিলেন। এবং সেই মেয়েও বাবার মৃত্যুর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পৃথিবী ত্যাগ করেন।
এই লোকের এই ভাগ্য দেখলে "বাঙ্গালি সামাজিক প্রাণীরা" কী বলবে?
কিছু বলার আগে তাঁর পরিচয় দিয়ে দেই। তিনি হচ্ছেন, হযরত মুহাম্মদ (সঃ), পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব!
প্রতিটা সন্তানের মৃত্যুর ক্ষণে যিনি একটি কথাই বলতেন, "নিশ্চই আসমান জমিন সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি যখন যাকে যা খুশি দেবার ক্ষমতা রাখেন, এবং যখন যার কাছ থেকে যা খুশি কেড়ে নেবারও ক্ষমতা শুধুই তাঁর।"
মেয়ে সন্তান-ছেলে সন্তান নিয়ে নবীজির (সঃ) কোন পক্ষপাতিত্ব ছিল না। তিনি তাঁর কন্যাদের যেরকম স্নেহ করতেন, সেটা কিংবদন্তি হয়ে আছে। তাও আবার সেই আরব 'সভ্যতায়' যেখানে মেয়েদের জন্ম হলে পিতারাই তাঁদের নিয়ে যেতেন লোকালয়ের বাইরে, এবং তাঁদের জীবিত কবর দিয়ে আসতেন!
চৌদ্দশ বছরেও মানুষ সভ্য হতে শিখেনি। যেই দেশ মঙ্গলে যান পাঠায়, সেই দেশেই শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজন "কণ্যা ভ্রুণ হত্যা" করে থাকে। বলছি প্রতিবেশী দেশের কথা। ব্যপারটা আশংকাজনক, কারণ তাঁদের দেশে যাই ঘটে, সেটাই কিছুদিন পরে আমাদের দেশেও ঘটে থাকে। পেটের ভিতরে অকারনে কন্যা সন্তান হত্যা করলে কী পাপ হয় না? ওদের কে বুঝাবে?
সন্তানের প্রাকৃতিক মৃত্যুতে নবীজি(সঃ) কিভাবে শক্ত থাকতে পারতেন? কারণ তিনি জানতেন তাঁর মালিক বিভিন্নভাবে তাঁকে পরীক্ষা করার ওয়াদা করেছেন। সুরাহ বাকারায় সেই মালিক (আল্লাহ) বলেছেন, "এবং আমি কিছু ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, জীবন এবং ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা নেব। তুমি সেসব ধৈর্য্যশীলদের সুসংবাদ দাও, যারা বিপদের সময়ে বলে, 'আমরাতো আল্লাহরই এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।' এরাই তাঁরা যাদের প্রতি তাঁদের মালিকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা বর্ষিত হয়, আর তাঁরাই সৎ পথে পরিচালিত।" (আয়াত নং ১৫৫-১৫৭ দেখে নিতে পারেন।)
আল্লাহ প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়েছেন! স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তিনি কিভাবে পরীক্ষা নিবেন! কখনও আমাদের ভয় এসে গ্রাস করবে। কখনও ক্ষুধার কষ্টে চোখে অন্ধকার দেখবো! ধনসম্পদ কখনও বেড়ে যাবে, আবার কখনও সব হারিয়ে পথের ফকির হয়ে যাব। কখনও নিজে বেঁচে গিয়ে প্রিয় মানুষদের মরতে দেখবো। আমাদের পরীক্ষা দিতে হবেই। এড়ানোর কোনই উপায় নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে মাথা নত করে মালিকের হুকুম মেনে নেয়া। ব্যস! তাইলেই পাশ!
এবং আসল কথা হচ্ছে, এছাড়া আমাদের আরতো কোন উপায়ও নেই। আমার প্রিয় কেউ মারা গেছে, তাই আমি উপরওয়ালার সিদ্ধান্তের উপর অভিমান করে 'নাস্তিক' হয়ে গেলাম! এতে কী সে ফিরে আসবে? বরং এমন দোয়া করাটাই কী ভাল নয় যে "আমার বাকি প্রিয় মানুষদের এত দ্রুত আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না।"
মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমাদের দেশে একজন মানুষের একটি সন্তান মারা গেলেই, অথবা কোন দূর্ঘটনা ঘটলে, কিংবা মেয়ে সন্তান হলে আমরা দল বেঁধে 'ব্যাক বাইটিং' শুরু করে দেই, "নিশ্চই কিছু একটা করেছে....পাপের ফল!"
তাহলে নবীজির (সঃ) সাত সাত জন সন্তান কেন এত অল্প বয়সেই মারা গেল? কেন উনার বংশধর মেয়ের মাধ্যমেই প্রবাহিত হলো? উনারতো কোন পাপের রেকর্ড চোখে পরেনা!
একজন মানুষের ক্যানসার বা এইরকম ভয়াবহ কোন রোগ হলে আমরা অতি সহজেই বলে দেই, "পাপের শাস্তি!"
তাহলে আপনার প্রিয়জনদের অথবা আপনার নিজের যখন একই রোগ হয়, তখন কেন চুপ করে থাকেন?
মজার ব্যপার হলো, আমি এমন অনেককেই চিনি, যারা সারাজীবন মানুষের দূর্বলতা, মানুষের খুঁত ধরে কথা শুনিয়েছেন। মানুষের মনে আঘাত দিয়ে মজা লুটেছেন। পরবর্তী সময়ে একটা একটা করে সবকিছুই তাঁর জীবনে ঘটেছে। What goes around, comes around আর কি। তারপরেও তাঁরা শুধরান না। বিরতিহীনভাবে পরনিন্দা চালু থাকে।
যখন আমাদের প্রতিকূলে সব যেতে শুরু করে, মনে হয় আমাদের বুঝি আল্লাহ পছন্দ করেন না। অথচ একটু চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পেতাম আমার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে আছে। "সবকিছুতেই সফল" টার্মটা কেবল হিন্দি-বাংলা সিনেমার নায়কদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
"আমি এটা পেলাম না, ও ওটা পেয়ে গেছে!" - না ভেবে বরং এইটা ভাবুন, "আমার এটা আছে, ওর সেটা নেই!"
একজন চরম ঐশ্বর্য্যশালী ব্যক্তির সাথে মিশে দেখুন, পারিবারিক সুখ কী, তা তিনি জানেন না। টাকা পয়সার অভাব নেই জীবনে, কিন্তু স্ত্রী-পুত্র-সন্তানদের সাথে তাঁর সেইরকম বন্ধন নেই। আবার উল্টো দিকে, একজন সাধারণ মধ্যবিত্তের হয়তোবা টাকা পয়সা নেই, কিন্তু তিনি যা বলেন, তাই তাঁর সন্তানরা অতি শ্রদ্ধার সাথে পালন করে।
শফিক সাহেবের তিন সন্তানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে - আপনার সন্তানদের ভাগ্যে ঘটেনি বলে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান! এবং দোয়া করুন আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে যেন তা না ঘটে।
আবার শফিক সাহেবের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বলতে গেলে, আমরা জানিনা আমাদের ভবিষ্যতে কী আছে। আল্লাহ বলেন, ভবিষ্যতের মালিক শুধুই তিনি। এবং তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য যা ভাল, সেটাই করেন।
কে জানে, তাঁর একটা ছেলে বড় হয়ে কালা জাহাঙ্গীরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতো।
আপনার ছেলে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, এইটা বেশি কষ্টকর, নাকি আপনার ছেলে শৈশবেই মারা গেছে - এই অনুভূতি বেশি কষ্টকর? এরশাদ শিকদারের মা বেঁচে থাকলে তাঁকে প্রশ্নটা করা যেত।
কাজেই, অতীতে যা ঘটে গেছে, সেটা নিয়ে আফসোস করতে করতে নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে শুধু শুধু নষ্ট করা কেন?
আমি মৃত্যু দিয়ে উদাহরণ দিলেও, যেকোন রকমের বিচ্ছেদ কিংবা ক্ষতির জন্য উপরের কথাগুলো প্রযোজ্য।
Post Written by:মঞ্জুর চৌধুরী
No comments:
Post a Comment