Labels: , , ,

পিতা মাতাকে সম্মান করুন

●|● পিতা মাতাকে সম্মান করুন ●|●
ইউটিউব লিংক: https://youtu.be/j3wLqPAAnm8

"তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।" [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩-২৪]

আসসালামু আলাইকুম কুরআন উইকলি। আমি কুরআনের কিছু আয়াত নিয়ে আপনাদের ৪-৫ মিনিটের রিমাইন্ডার দিয়ে চাই যেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, আল্লাহ বলেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ
যার অর্থ মূলত, তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করো না। তাহলে আয়াতের প্রথম অংশ আমাদের ওপর আল্লাহর অধিকারের ব্যাপারে দাবি জানাচ্ছে। আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে,
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
“তুমি কেবল তারই ইবাদাত করবে” বলার পরপরই আল্লাহ বলছেন, “তুমি অবশ্যই তোমার পিতামাতার সাথে সর্বোত্তম আচরণ করবে।” ভাষাগত ব্যাকরণে না যেয়ে বলা যায় যে ‘ইহসানান’ শব্দটি দ্বারা এখানে জোর উপদেশ দেয়া হয়েছে। আপনি তাদের সাথে যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করবেন। আর এখানে মনে হতে পারে যে আয়াতের অর্ধেক অংশে আল্লাহ সম্পর্কে আর বাকি অর্ধেকে পিতামাতার ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু আপনি যদি লক্ষ করেন, আয়াতের অধিকাংশই পিতামাতার ব্যাপারে কথা বলছে।


 প্রথমে আল্লাহ বলছেন, “তুমি তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে”, এরপর তিনি বলেন,
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ
“তারা যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়”
أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا
“...তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই...”
فَلاَ تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ
“...তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না”
আমি এ ব্যাপারটায় এক্টূ পরেই ফিরে আসবো।
وَلاَ تَنْهَرْهُمَا
“... আর তাদেরকে ধমক দিয়ো না বা দূরে ঠেলে দিয়ো না...”
وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا
“আর বিশেষ করে তাদের সাথে সম্মানের সাথে ও শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বলো।”


একটার পর আরেকটা, তারপর আরেকটা এভাবে একের পর এক জায়গায় শুধুই পিতামাতাকে নিয়ে বলা হয়েছে। মাত্র একবার আল্লাহর সম্পর্কে বলা হয়েছে, আর বাকি সব অংশ পিতামাতার ব্যাপারে কথা বলছে। তাই চিন্তা করে দেখুন, এ বিষয়টি কতই না গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে প্রশংসনীয় ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ নিজেকে প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আর এখানে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো আপনি প্রকৃতপক্ষে আপনার পিতামাতার কাছে ভালো হতে পারবেন না যদি আপনি আসলেই আল্লাহর বান্দা ও ইবাদাতকারী না হন। আপনি যদি প্রথম অংশটি যথার্থভাবে পালন না করেন তাহলে দ্বিতীয় অংশে এসেও আপনি ব্যর্থ হবেন। তাই আপনাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের পিতামাতার সাথে সম্পর্কের মাঝে গড়বড় ঘটান সেটা কী বলে দেয়? এটা বলে দেয় যে আপনি প্রকৃতপক্ষে এখনো আল্লাহর বান্দা হতে পারেননি। আপনি প্রথম করনীয় কাজটি এখনো করেননি। কেননা পরেরটা করা আপনার জন্য সহজ হয়ে যেত যদি আপনি তার আগেরটা করতেন। এটা হল প্রথম পয়েন্ট। 


দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো, সর্বোত্তম হওয়া বলতে আসলে কী বুঝায়? এখানে বলা হচ্ছে, “ওয়াবিল ওয়ালিদাইনি...”। এমনকি “ওয়া ইহসানান বিল ওয়ালিদাইনি” বলা হয়নি, তাহলে এটার ভিন্ন অর্থ হতো। “ওয়াবিল ওয়ালিদাইলি ইহসানান”। যেটা বুঝাচ্ছে যে, ‘বিশেষভাবে’ যখন আপনার পিতামাতার কথা বলা হয়, অন্যদের সাপেক্ষে যখনই পিতামাতার ব্যাপার চলে আসে, আপনি তাদের কাছে সর্বোত্তম হবেন। অন্যকথায়, নিজের বসের কাছে ভালো হওয়া খুবই সহজ, কেননা আপনি তার সাথে ঝামেলায় জড়ালে নিজেই বিপদে পড়বেন। আপনার প্রফেসরের সাথে ভালো আচরণ করা স্বাভাবিক, কারণ তিনি আপনাকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিতে পারেন। একইভাবে আপনার বন্ধুদের কাছেও, কেননা আপনি তাদের হারাতে চান না। কিন্তু যখনই আপনার পিতামাতার কথা আসে আপনি তাদেরকে নিজের প্রাপ্য বলে ধরে নেন। তাই আল্লাহ বলছেন যে, না, যখনই পিতামাতার ব্যাপার চলে আসে... ধরুন আপনি ফোনে বন্ধুর সাথে কথা বলছেন আর আপনার মা আপনাকে ডাক দিলো। আপনি তক্ষণই তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাবেন। ব্যাস! এখানে আর কোন ‘কিন্তু’ নেই। আপনি ভিডিও গেমস খেলছেন আর আপনার মা বললেন “নাস্তা রেডি!” আপনি বলবেন না “দাড়াও না! বললাম তো আসছি! একটু বসে থাকো!” না না না।

সাথেই সাথেই সেটাকে রেখে দিন, চলে যান। আমি আপনার বাসায় থাকলে আপনার টিভিটাই ভেঙে ফেলতাম। “যান আপনার মায়ের কথা শুনে আসুন।” এটা আমাদের দ্বীনে একটি প্রাথমিক দায়িত্ব। “ওয়াবিল ওয়ালিদাইনি ইহসানা”।
এরপর আল্লাহ বলেন,
“ইম্মা ইয়াব্‌লুগ্বন্না ঈনদাকাল্‌ কিবার আহাদু হুমা উকিলা হুমা”

এটিকে তিনি একটি বিষয়বস্তু হিসেবে উল্লেখ করেছেনঃ তাদের একজন বা উভয়েরই বার্ধক্যে উপনীত হওয়া। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, যখন আমাদের মাতাপিতার বয়স বাড়তে থাকে তার সাথে সাথে তাদের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। আর তারা যখন বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে, আপনিও একই সাথে আরও স্বাধীন হতে থাকছেন এবং একসময় প্রাপ্তবয়স্কে উপনীত হন। তখন আপনি ভাবেন যে আপনি নিজেই নিজের সিদ্ধান্তগুলো নেবেন, এখন আপনার নিজের একটা জীবন আছে আর তারা এখনও আপনাকে বাচ্চা হিসেবে দেখছে, তারা আপনাকে বুঝতে পারেনা, এরকম নানা অভিযোগ আপনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনি আপনার বন্ধুদের কাছে এগুলো বলে বেড়ান।

কিন্তু আল্লাহ বলছেন যে, ‘বিশেষভাবে’ যখন তারা বৃদ্ধ হয়ে পড়ে, ‘বিশেষভাবে’ যখন তারা অযৌক্তিক হয়ে যায়, ‘বিশেষভাবে’ যখন তারা আর আপনার প্রেক্ষাপট বুঝতে পারে না, আপনার ওপর নানা দাবিদাওয়া চাপাতে থাকে, তখনই সময় তাদের কাছে সর্বোত্তম হওয়া। আর যে আল্লাহর ভালো বান্দা নয় তার কাছে এটা মোটেও সহজ হবে না। এগুলো তাদের জন্য না, বরং আল্লাহর জন্য করতে হবে। এটা হল দ্বিতীয় দিক যা আল্লাহ উল্লেখ করেছেন।
তারপর তিনি বলেন,
“ওয়া লা তানহার হুমা”
“তাদেরকে ধমক দিয়ো না কিংবা দূরে সরিয়ে দিয়ো না”

ঠিক একই আদেশ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম)-কে দেয়া হয়েছিলো এতিমদের ব্যাপারে। ফাআম্মাল ইয়াতিমা ফালা তানহার। একই শব্দ, তাইনা? “এতিমদেরকে ধমক দিয়ো না, তাদের দূরে ঠেলে দিয়ো না।”
তার পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন না। আপনার মা আপনার সাথে কথা বলছে আর আপনি হুট করে চলে যান অথবা আপনি কথা বলার সময় তাকে দিকে তাকানও না। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত! মায়ের সাথে কিভাবে আপনি এমনটা করতে পারলেন? আপনার জন্য তিনি কতইনা কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছেন। আর আপনি তার সব কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে বলতে থাকেন “আরে আমার মা সারাক্ষণ চ্যাঁচামেচি করে, বকবক করে...”

কী চরম অকৃতজ্ঞতা! শুধু আপনার মায়ের প্রতি না, প্রথমে আল্লাহর প্রতি আবার এর ওপর আপনার মায়ের প্রতি। আপনি ইমানদার না হলেও... আপনি কি ভুল গেছেন?... আপনার হয়তো মনে নেই যে আপনি তার গর্ভের মধ্যে ছিলেন। যে কারণে একটু পরপরই তার বমি হতো... ভেতর থেকে আপনি তার পাঁজরে লাথি মারতেন... আর পেট থেকে বের হওয়ার সময় আপনি তাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন। কত ব্যথা-বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি আপনাকে লালনপালন করেছেন, রাতে ঘুমোতে যাননি।

আর আপনি কেবল মনে না থাকার কারণেই এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন না। এজন্য আপনি যাচ্ছেতাই ভাবে তার সাথে কথা বলেন।
“ওয়া ক্বুল লাহুমা ক্বওলান কারীমা”
“তাদের উভয়ের সাথে সম্মানের সাথে, শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বলো।”
আপনাদের অনেকেরই মুখ দিয়ে বাজে শব্দ, খারাপ ভাষা বের হতে থাকে কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো। আপনি এগুলো বলার সময় একটু চিন্তাও করেন না। পিতামাতার সাথে কথা বলার সময় আপনার অবশ্যই এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এমনিতেও এসব ভাষা ব্যবহার করা উচিত না। বিশেষ করে পিতামাতার সাথে তো মোটেও না।

এরপরে আরও একটি আয়াত পিতামাতাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে, “ওয়াখ্‌ফিদ্ব্‌ লাহুমা জানাহায্‌ যুল্লি মিনার্‌ রহ্‌মাহ্‌”। সুবহানাল্লাহ! “তোমার কোমলতা ও বিনয়ের ডানা অবনত করো”। আরবিতে ডানা নত করার অর্থ হলো আপনার পাখির মতো ঊড়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু তারপরেও আপনি নিচে যেকোনো জায়গায় নেমে আসেন। আপনার চলে যাওয়ার ক্ষমতা আছে, তাদের মুখের সামনে জোরে দরজা লাগিয়ে দিতে পারেন কিংবা ফোন কেটে দিতে পারেন। তবুও এগুলো সহ্য করেন, তাদের বকবকানি মেনে নেন। কিন্তু আপনি যদি আমাকে বলেন বা ফেসবুক পেজে লেখেন “আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার পিতামাতার মাথা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে” অথবা “আমার ব্যাপারটা পুরো আলাদা”; কী মনে হচ্ছে? প্রত্যেকেই ভাবে যে তাদের অবস্থাটা অন্যদের থেকে আলাদা। কেউ ভাবে না যে এগুলো তাদের ক্ষেত্রে খাটে, সবাই মনে করে এই কথাগুলো পাশের কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে যার অবস্থা স্বাভাবিক।

আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে খুব ভালো করেই জানেন। তাই তিনি আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত থেকেই এ কথাগুলো বলেছেন। তাই তাদের প্রতি বিনয়ের ডানা অবনত করুন।
আমার শেষ মন্তব্য, “...মিনার্‌ রহ্‌মাহ্‌” আয়াতের এই শেষ অংশে... আমি মাঝখানে অনেক বিষয় রেখে চলে যাচ্ছি কারণ আমার আপনাদের মনোযোগ দরকার।

তো, “মিনার্‌ রহ্‌মাহ্‌”, “দয়া পরবশ হয়ে”, এটি অন্তত তিনটি দিক বুঝায়। প্রথমত, আপনি তাদের প্রতি বিনয়ী হবেন যদিও তার বিপরীত হবার ক্ষমতা আপনার আছে। আপনি তা করবেন কারণ তারা এমন বয়সে উপনীত হয়েছে যখন আপনার দয়া তাদের খুব প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, কেননা তারা আপনি ছোট থাকা অবস্থায় তারা আপনার প্রতি দয়া করেছিলো। আর তারা কিন্তু এসবকিছু রেকর্ডে লিখে রেখে বিল বানিয়ে আপনাকে দিয়ে বলেনি “দ্যাখো, আমরা তোমার এতো সেবা-যত্ন করেছি, এত ঘন্টা তোমার প্রেছনে শ্রম দিয়েছি। এখন এর মূল্য পরিশোধ করো।”
না, তারা আপনাকে দয়া দেখিয়েছে, এখন আপনারও তাদের প্রতি দয়া করার সময় এসেছে। তৃতীয় এবং সর্বশেষ পয়েন্ট হলো, আপনি যদি চান আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুক, আপনি তাদের প্রতি দয়া দেখান। মিনার্‌ রহ্‌মাহ্‌।
আল্লাহ আমাদেরকে পিতামাতার প্রতি সর্বোত্তম বানিয়ে দিন। আর তিনি যেন আমাদের এই আয়াতগুল উপলব্ধি ও সে অনুযায়ী জীবনযাপন করার তাওফিক দেন। বারাকাল্লাহু লি ওয়ালাকুম ফিল কুরআনিল হাকিম...আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

No comments:

Post a Comment