Labels: , , , ,

ইসলামে স্ত্রীর অধিকার

আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। গাল্ফ ট্যুরে থাকা কালীন আমি বেশ কিছু চিঠি পেয়েছি।এটা তার মাঝে একটা।
‘আমি একজন অমুসলিম, কুয়েতে অল্প কয়েক বছর ধরে কাজ করছি।আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম কারণ আমি আমার অফিসের এক ধার্মিক মুসলিম কলিগ কে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।আর আমি তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।’

উস্তাদ-আচ্ছা!

‘আমি তাই ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে চাচ্ছিলাম।আমি যেই মানুষটিকে পছন্দ করেছি তিনি একজন পাকিস্তানি ভাই।তার কালচার আরও ভালো ভাবে জানার জন্যে, আমি একজন মহিলা কলিগের সঙ্গ নিলাম যে এক পাকিস্তানি পরিবারে বিয়ে করেছিলো।আমি ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্যে কুরআন পড়ছি। আর এতে একজন স্ত্রীকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা খুবই হৃদয়গ্রাহী এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ।কিন্তু যখন আমি আমার মেয়ে বন্ধুটির জীবনের দিকে তাকাই, তাকে এত কিছু করতে হয় তার শ্বশুর বাড়ির জন্যে।আর তার স্বামী তাকে জোর করে সে যেন তার শাশুড়ির সেবা-যত্ন করে।আর তার শাশুড়ি তাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়ে থাকে।তিনি তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া সৃষ্টি করে। এদিকে তার ননদেরা তাকে সব সময় কাজের মেয়ের মত খাটায়।তার স্বামী এ ব্যাপারে অনেক কঠোর।আমি এক্ষেত্রে অনেক অবিচার দেখতে পাই।তিনি তাকে ভয় দেখান যে তিনি স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যাবেন যদি সে কথা না শুনে, শ্বশুরপক্ষের সকলের ইচ্ছা পূরণ না করে।এটাই যদি ইসলামের আসল রূপ হয়, আমি মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত।এ ব্যাপারে আপনার উপদেশ কি?’

উস্তাদ- আমি আসলে প্রথমবারের মত এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি,আমাকে বেশ কিছু মানুষ জিজ্ঞেস করে একজন নারীর অধিকার সম্পর্কে...বিশেষ করে তার শ্বশুরপক্ষের কাছে কি অধিকার আছে সে সম্পর্কে।এটা বেশ জটিল একটা বিষয়।তবে আমি কিছু মূল ধারণা সকলের কাছে উপস্থাপন করেতে চাই।যেই বোন প্রশ্নটি করেছেন, প্রথমত আপনার এই প্রশ্নের জন্যে ধন্যবাদ।আর এই প্রশ্ন শুধু আপনার নয়, আমার মনে হয় আরও অগণিত মানুষ এ থেকে উপকৃত হতে পারেন ইনশাআল্লহু তা’আলা।


প্রথমত, ইসলামে যেকোনো সম্পর্ক কিছু অধিকার ও কর্তব্যের ভিত্তিতে স্থাপিত।একজন পুরুষ হিসেবে আমার স্ত্রীর প্রতি আমার কিছু কর্তব্য রয়েছে।ঠিক যেমন আমার প্রতি তার কিছু দায়িত্ব রয়েছে।আর বাবা-মায়ের প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে, ঠিক যেমন আমার প্রতি তাদেরও দায়িত্ব আছে।তাদের কাছে আমার কিছু অধিকার আছে।এখন, এক্ষত্রে মূলনীতি হলো, আপনি যেকোনো একটি সম্পর্কের অধিকার আদায় করতে গিয়ে অন্য আর একটি সম্পর্কের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারেন না।প্রশ্ন হলো আপনি কিভাবে সব অধিকারের সমন্বয় ঘটাবেন?বিশেষ করে আমরা এখন কথা বলছি একজন স্বামী, স্ত্রী ও তার শ্বশুর পক্ষের ব্যাপারে।একজন ছেলেসন্তান হিসেবে আমাকে আমার বাবা-মায়ের প্রতি অনুগত হতে হবে, তাদের সম্মান দেখাতে হবে,দয়া দেখাতে হবে।তারা আমার কাছে যাই চায়, তা পূরণ করতে হবে।যদি না তারা আমাকে ইসলামের বাইরে কিছু করতে আদেশ দেয়, কিংবা আল্লাহকে অমান্য করতে আদেশ দেয়।


এটা ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে তাদের অনুগত থাকতে আমার কোনো সমস্যা থাকা উচিত নয়।অন্যদিকে আমার স্ত্রীকেও তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, সাধারণ শিষ্টাচার দেখাতে হবে।কিন্তু তাকে তাদের বাধ্যগত হয়ে চলতে হবে না।আর স্বামী হিসেবে আমি যদি তার কাছে আমার বাবা-মায়ের সেবা দাবি করি তাহলে আমি তার প্রতি অবিচার করছি।স্ত্রীকে তার নিজের বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্যশীল হতে হয়, তার তো নিজের অভিভাবক রয়েছে।এরা তার নিজের অভিভাবক নয়, আপনার অভিভাবক।যেটা সত্য কথা, রক্তের বন্ধনে যে সম্পর্ক হয় আর বিয়ের বন্ধনে সে সম্পর্ক হয় তা মোটেই এক নয়।তো স্বামী হিসেবে আপনার স্ত্রীর কাছে আপনার বাবা-মায়ের সেবা আশা করা এক ধরনের অবিচার।আর ইসলাম তা সমর্থন করে না।এমন কোনো নীতিও দেওয়া হয়নি এ ব্যাপারে।কিছু মানুষ জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু আপনাকে তো আপনার স্বামীর আনুগত্য করতে হবে, সে যাই করতে বলুক না কেন!’এটাও সম্পূর্ণ সত্যি নয়।আমরা কোনো মানুষেরই এতটা বাধ্যগত নই যে, ‘সে যাই করতে বলুক না কেন’ তা করতে হবে।আমি আমার বাবা-মায়ের আনুগত্য করতে পারবো না তারা যা বলবে তার সব কিছুর ব্যাপারে।আমার বাবা যদি আমাকে স্টুডেন্ট লোন নিতে বলতেন, যা সুদের ভিত্তিতে দেওয়া হবে, আমি তা করতাম না।আমি এটা করতে পারি না।

এতে আল্লাহর অবাধ্যতা হয়।আমি এমনটা করব না।আর এমনও হয় মাঝে মাঝে যে আপনাকে সম্মানের সাথে আপনার বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে হবে কারণ তারা অযৌক্তিক কাজ করতে বলছে।এরকমও হতে পারে...আপনার বাবা আপনাকে বলছেন লোন নিতে যা সুদের ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে না কিন্তু তিনি আপনাকে এমন ব্যবসায় যেতে বলছেন যার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত যে আপনার বেশ ক্ষতি হবে, আপনি নিশ্চিত জানেন যে এই ব্যবসা কোনোভাবেই চলবে না।অথচ তিনি চাইছেন আপনি আপনার জীবনের সব পুঁজি সেই ব্যবসায় ঢেলে দিন।সেই মুহূর্তে আপনার বাবার কথা না শুনা তার অবাধ্যতা নয়।এভাবে ভাবলে চলবে না।বস্তুত, অভিভাবকের বাধ্যগত থাকার অর্থ যৌক্তিকতার ঊর্ধে নয়।আর অবশ্যই আমরা যখন তাদের অবাধ্য হই, আমরা কক্ষনো, কোনোভাবেই তাদেরকে অসম্মান করে তা করি না।আর এটাও সত্যি আমাদের জন্যে যদি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, আমাদের প্রতি যদি তারা কঠোরও হন সেক্ষেত্রেও তাদের আনুগত্য করতে হবে।কিন্তু যদি তারা অযৌক্তিক কিছু করতে বলেন, কিংবা এমন কিছু যা অন্যকে সমস্যার সম্মুখীন করে তোলে...আমি উদাহরণ স্বরূপ যা বলেছি, আমি যদি সব পুঁজি দিয়ে তাদের কথা মত এমন ব্যবসায় নেমে পড়ি যেটা সফল হবে না, এতে আমি তাদের ইচ্ছামত কাজ করেছি ঠিকই কিন্তু আমি আমার বাচ্চাদের কষ্টের মুখে ফেলে দিয়েছি, আমার স্ত্রীকে কষ্ট দিচ্ছি এবং যারা আমার উপর নির্ভর করে আছে তাদের সকলকে সমস্যায় ফেলছি।আমি এমন কাজ করতে পারি না।তারা আমাকে যা খুশি তা করতে বলতে পারেন কিন্তু তারা আমাকে দিয়ে অন্য কারও উপর অত্যাচার করাতে পারেন না।এভাবে অধিকার আদায় করা যায় না।

কিছু পরিবার আছে যারা সেই স্বামীকে জোর করেন কেবল একটা একাউন্ট রাখতে, আর তার অভিভাবকেরা হলেন সেই একাউন্টের কো-সাইডার।এদিকে স্ত্রী সপ্তাহে কেবল হয়ত ২০ ডলার করে পাচ্ছেন।এভাবেও জীবন যাপন করলে চলবে না।আপনি এটা করতে পারেন না।আপনি আপনার স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন, আপনি তার ওয়ালী হয়ে তাকে তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন।আপনাকে এখন তার প্রতি সেসব কর্তব্য পালন করতে হবে যা তার প্রতি তার বাবা করে এসেছেন।কিন্তু এখানে ঘরে সকলে তার সাথে ২য় শ্রেনীর মানুষের মত আচরণ করে, যেন সে শ্বশুর-শাশুড়ির কাজের মেয়ে কিংবা আপনার বোন অথবা অন্য কারও কাজের মেয়ে।এটা চরম প্রতারণা এবং এটা এমন এক বিষয় যার ব্যাপারে আপনাকে এবং আমাকে শেষ বিচারের দিন জিজ্ঞেস করা হবে।

অন্যদিকে আছে আরেক চরম্পন্থীরা।একদিকে আমরা দেখি বউকে বাড়ির কাজের মেয়ে বানিয়ে ফেলা হয়েছে যা চরম অবমাননাকর এবং উদ্ভট।কোনোভাবেই যা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।আর অন্যদিকে আছে এমন সব স্ত্রী অথবা স্বামী যারা তাদের শ্বশুরপক্ষের সকলের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ… তাদের কারও সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না, তাদের মুখও দেখতে চাই না, আমি চাই না তারা আমাদের বাসায় আসুক...আমি চাই না তুমি তোমার মায়ের বাসায় যাও, তার সাথে কথা বল...আমি তাকে ঘৃণা করি,তাকে আমি সহ্য করতে পারি না...ইত্যাদি ইত্যাদি।এভাবে অত্যাধিক দূরত্ব সৃষ্টি করেন আপনার স্বামীর পরিবার থেকে।এটাও একধরনের চরম্পন্থা। আর এটাও অবিচার।


তারা আপনার স্বামীর অভিভাবক।তাদের অধিকার আছে আপনার স্বামীর উপর।তারা যেন তাদের নাতি-নাতনিকে দেখতে আসতে পারে।তারা যেন আপনার বাসায় ‘ঝগড়া সৃষ্টি হবে’ এমন দুশ্চিন্তা করা ছাড়াই আসতে পারে...অথবা তাদের উপস্থিতিতে আপনি যেন তাদের সামনে স্পষ্টভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে বসে না থকেন।তো এতে আপনি আপনার দিক থেকে অত্যাচার করছেন আপনার স্বামীর উপর, কারণ তার প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে আপনার অন্তত তার পরিবারের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করা উচিত।ভদ্রতা এবং শ্রদ্ধা করা...এতটুকুই তো!আপনার স্বামী আপনার উপর তা চাপিয়ে দিতে পারেন না কিন্তু এই আচরণ তো আপনার নিজ থেকেই আসা উচিত।আর এগুলো তো এমন বিষয়...আপনাদের ঘোর কাটানোর জন্যে বলছি...এই সৌজন্যমূলক আচরণ গুলো তো সব মুসলিমই অন্য মুসলিমের প্রতি করে থাকে।যারা একই পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছে তাদের কথা তো না বললেও হতো!আমাদের এমনিতেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সর্বোচ্চ সুন্দর ব্যবহার করা উচিত। হ্যাঁ, জটিল অবস্থারও সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে।সত্যিই, সেসব জটিল পরিস্থিতিতে চলে যায়।অন্যান্য অনেক কালচারের মধ্যে...বিশেষ করে ‘দেশি’ কালচারে আমরা সকলে মিলে এক ছাদে থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করি।

আর পরিবারের খরচাপাতি বাবা-মা পরিচালনা করেন।আর বউকে এই করতে হবে, সেই করতে হবে...একজন ভালো স্ত্রী হিসেবে পরিচয় পেতে।এই নীতি বেশির ভাগ পরিবারের ক্ষেত্রেই কাজে দেয় না। আর যদি কাজে না দেয় বোনেরা, আমি বলছি না আপনারা এক্ষত্রে বিয়ে ভেঙ্গে ফেলুন।তবে এটা বাস্তবিকই আলোচনার দাবি রাখে।কারণ এই পন্থা ইসলামিক নয়।যদিও আপনারা পুরো পরিবার মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,এই সিদ্ধান্তকে ইসলামের আড়ালে লুকিয়ে রেখে ভাববেন না ইসলাম আপনার কাছে এটাই চায়।ইসলাম আপনার কাছে এমন কিছু প্রত্যাশা করেনি, এটা আপনার পরিবার চেয়েছে।কিছু ব্যাপারে আপনাকে পরিবারের সকলকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।আল্লাহ আযযা ওয়াজাল বলেছেনঃ
ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ
“তোমরা যেসব নি’আমত ভোগ কর সে ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে।”

আমার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, বাবা-মা...এরা সবাই আল্লাহর নি’আমত যা আমি উপভোগ করি।তাই আমার উচিত তাদের অধিকার আদায় করা।তো আমি প্রার্থনা করছি যেন এই কথা গুলো যেন এসব ভ্রান্ত ধারণাকে কিছুটা হলেও হ্রাস করে যারা ভাবে যে, এটা আসলে ইসলামেরই আদেশ।ইসলাম এ ব্যাপারে এমন কিছু বলেনি।এটা কেবলই সংস্কৃতির অপচর্চা...যেভাবে মেয়েদের সাথে আচরণ করা হয়ে থাকে...কুরআন একে সমর্থন করে না, রাসূলের (স) সুন্নাহ কোনোভাবেই একে সমর্থন করে না।

বারাকাল্লাহু লি ওয়ালাকুম, ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

https://youtu.be/zP7SR6NetxU

No comments:

Post a Comment